মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম: সন্তানদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি?

সন্তানেরা মুক্ত এবং ভয়হীন পরিবেশে বড় হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচবে, এটাই ছিল পূর্বসূরিদের চাওয়া। কিন্তু সেটা এখন কতটা বাস্তব? ছবি: প্রথম আলো
সন্তানেরা মুক্ত এবং ভয়হীন পরিবেশে বড় হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচবে, এটাই ছিল পূর্বসূরিদের চাওয়া। কিন্তু সেটা এখন কতটা বাস্তব? ছবি: প্রথম আলো

আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের সবাই পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি বা চূড়ায় অবস্থান করছি। এখনই সময় পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে সাধ্য অনুযায়ী অবদান রাখার। আমরা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম যে পরম সৌভাগ্যবান ছিলাম, তাতে নিশ্চয় কারও কোনো সন্দেহ নেই। কেননা, কেউ তো শৈশবকাল থেকে আবার কেউ জন্মের পরপরই স্বাধীন দেশের মুক্ত আলো-বাতাসে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। স্বাধীনতা আমাদের পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া যে কত বড় পুরস্কার, তা আমাদের কারও না বোঝার কথা নয়। কেননা, স্বাধীনতার জন্য আমাদের পূর্বসূরিদের ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন–সংগ্রাম করতে হয়েছে। লাখ লাখ তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধ থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলন এবং সংগ্রামের সব বীর শহীদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ ও ঋণী।

আমরা বিশেষভাবে ঋণী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, যাঁরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আমাদের জন্য একটি স্বাধীন ভূখণ্ড রেখে গিয়েছেন। তাঁরা পরাধীনতার গ্লানি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই হয়তো তাঁদের প্রিয় সন্তানদের, অর্থাৎ আমাদের স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে বেড়ে তোলার আশায় বুক বেঁধে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতে পিছপা হননি। তাঁদের স্বপ্ন ছিল তাঁদের সন্তানরা অর্থাৎ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে মুক্ত মনের অধিকারী হব, যেখানে থাকবে না কোনো ভয়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন এমনকি কোনো হুমকি–ধমকি। তাঁরা মূলত চেয়েছিলেন আমরা মুক্ত ও ভয়হীন পরিবেশে বড় হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচি। আমাদের পূর্বসূরিদের এই চাওয়াই তো স্বাভাবিক। কত বাস্তব ছিল তাঁদের এই চাওয়া!

এখন চিন্তা করুন তো আমরা আমাদের সন্তানদের কতটুকু ভালোবাসি। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম হিসেবে দেশ গড়ার দায়িত্বটা তো আমাদের ঘাড়েও বর্তায়। আর সেটা তো আমাদের সন্তানদের জন্য পুরস্কারস্বরূপ হওয়ার কথা। যোগ্য পিতার কাছে সন্তানের এটা তো সামান্য দাবি যে তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য দেশ রেখে যাব। যেমন আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদের জন্য তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন।

তারা যদি আজ প্রশ্ন করে, তোমরা আমাদের জন্য কেন এমন একটা দেশ রেখে যাচ্ছ, যা দুর্নীতিতে বারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, যেখানে নির্যাতিতার আর্তি কেউ শোনে না, যেখানে ছেলে অসুস্থ মাকে জঙ্গলে ফেলে যায়, যেখানে মা–বাবার ভরণপোষণের জন্য ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়, যেখানে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই। তারা যদি এ প্রশ্নও করে, তোমারা আমাদের জন্য কী সমাজব্যবস্থা রেখে যাচ্ছ, যেখানে বইয়ের চাপে আমাদের শৈশব চুরি হয়, যেখানে মুক্ত মনে খোলা মাঠে খেলতে পারি না, যেখানে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতে পারি না, যেখানে মুক্ত চিন্তা করতে পারি না, যেখানে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়, যেখানে তিন বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। তাহলে কী জবাব দেব? তারা সরাসরি প্রশ্ন করুক আর না করুক, আমাদের কি এসব প্রশ্নের জবাব প্রস্তুত আছে?

আজ হোক আর কাল হোক, এসব প্রশ্নের জবাব তো আমাদের দিতেই হবে। আমরা ভালোভাবে জানি, এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি আমাদের অনেকেরই নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য দেশ রেখে যেতে পারছি না? আসলে কি আমরা এর জন্য কোনো চেষ্টা করছি? আর চেষ্টা না করলে কেনইবা তা করছি না? কোন বাধা বা ভয় আমাদের তা থেকে বিরত রাখছে?

প্রত্যক্ষ কোনো বাধা বা ভয় আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে প্রচ্ছন্ন একটা ভয় সর্বক্ষেত্রে যে বিরাজমান তা অনুভব করা যায়। সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সংসদ সদস্য কিংবা মন্ত্রী, সবার ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন ভয় পরিলক্ষিত হয়। আর এ ভয়ের দুষ্টচক্র ক্রমাগতভাবে আমাদের আরও ভীত করে ফেলছে।

এই প্রচ্ছন্ন ভয় মূলত আমাদের নিজেদেরই সৃষ্টি। আর সেটা হয়তো আমাদের নেশাগ্রস্ততার জন্য। না, মাদকের নেশার কথা বলছি না। মাদক তো আমাদের কারও কারও সন্তানদের নেশা! আমাদের নেশা হলো অর্থের, ক্ষমতার এবং বিদেশে পরিবারকে প্রতিষ্ঠিত করার। এই নেশা মেটানোর জন্য আমাদের অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। আর অন্যায়কারী, দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা অত্যাচারী ব্যক্তি সর্বদা এক প্রচ্ছন্ন ভয়ে ভীত থাকে। তখন ভয় হয় প্রো-অ্যাকটিভ কিছু করতে গিয়ে যদি প্রমোশন বঞ্চিত হই, কিংবা পছন্দমতো জায়গায় পোস্টিং না পাই, কিংবা শাস্তিস্বরূপ দূরে কোথাও বদলি করে দেয়, কিংবা দলীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হই, কিংবা দলে কোনো পদ না পাই, কিংবা নেতা হওয়ার সুযোগ হারাই। ফলে আমরা নিজ নিজ কাজে মনোযোগিতার বদলে পরম তোষামোদী করে ঊর্ধ্বতনদের মন জয়ের চেষ্টা করি।

এসব কিছু করে আমরা চরম কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছি, যা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের কাছে কোনোভাবেই কাম্য নয়। অঢেল টাকার মালিক বানিয়ে, সুইস ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা রেখে, উঁচু ভবন বানিয়ে, কিংবা বিদেশে বাড়ি বানিয়ে, অট্টালিকা কিনে যদি মনে করি আমরা আমদের সন্তানদের খুব ভালোবাসি, তবে চরম ভুল করছি। আর এ শিক্ষা তো করোনাই আমদের দিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিকদেরও সামান্য ২০ হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাগাভাগি করতে গিয়ে অকালে প্রাণ দিতে হয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়।

আর মুক্তিযোদ্ধাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ পাচার করে সন্তানদের অন্য কোনো দেশের তিন নম্বর নাগরিক হিসেবে গোলামিতে অভ্যস্ত করার বোকামি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা যারা বিদেশে পরিবারকে প্রতিষ্ঠা করেছি কিংবা দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছি, তারা নিজেদের বুদ্ধিমান ভাবি এবং গর্ব করি। আর যারা তা করেনি বা সুযোগ পায়নি, তাদের বোকা ভাবি। কিন্তু আমরা যারা প্রথম দলে আছি, তারাই চরম বোকা। কেননা, একটা স্বাধীন দেশ থেকে অন্যায়ভাবে অর্থ পাচার করে আমরা আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চরম বেইমানি করছি। তা ছাড়া আমরা আমাদের অর্থ ও সন্তান—দুটোকেই পর করেছি। আর তারপর তো রয়েছে দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী শক্তির নামে বিদেশি খেদাও আন্দোলনের ভয়। করোনা–উত্তর পৃথিবীতে এই ভয় তো আরও প্রকট হতে পারে। আর যদি তা–ই হয়, তাহলে আমাদের সন্তানদের ঘটি-কম্বল ফেলে জীবন রক্ষার জন্য খালি হাতে ফিরতে হতে পারে।

তাই আসুন এসব বোকামি, হীন মানসিকতা, স্বার্থপরতা এবং ভণ্ডামি সম্পূর্ণ পরিহার করে অর্থ ও ক্ষমতার পেছনে দৌড়ানো বন্ধ করি। দুর্নীতিমুক্ত এবং ন্যায়বিচারমূলক সমাজ গড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানাই এবং আমাদের সন্তানদের জন্য দেশকে বাসযোগ্য করে তুলি। আর সেটাই হবে আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের সন্তানদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। আর তা না করতে পারলে আজ হোক বা কাল হোক, সন্তানদের প্রশ্নের কাঠগড়ায় তো দাঁড়াতেই হবে।

আর দেশকে বাসযোগ্য করতে হবে প্রশাসনিক কাঠামোসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের আমূল সংস্কার এবং বহুবিধ পরিবর্তনের মাধ্যমে। তার শুরু হোক সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার ক্ষেত্রে অর্থ ও পেশিশক্তির পরিবর্তে সৎ, জ্ঞানী, কর্মঠ, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিকদের মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে। আর এটা করতে হলে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক কাজের দায়িত্ব দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম হিসেবে এসব কাজের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।

ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]