হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গঠন করা জরুরি

করোনাকালে বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চ আদালতগুলো মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিষ্পত্তি করছেন। কিন্তু পদ্ধতিগত কারণে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধান অর্পিত সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে অপারগ থাকছেন।

সব থেকে যা উদ্বেগজনক সেটা হলো, বাংলাদেশ সংবিধানের কতগুলো নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদের কার্যাবলি বর্তমানে অকার্যকর বা আধা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। অথচ এটা অনস্বীকার্য যে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া সংবিধানের কোনো বিধানের কার্যকারিতা খর্ব বা রহিত করার সুযোগ নেই।

সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদটির কার্যকারিতা করোনাকালে সব থেকে মূল্যবান। কারণ, কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে সংবিধানের
মৌলিক অধিকার ভাগে বর্ণিত অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশ বা আদেশাবলি দিতে পারেন। কিন্তু এ জন্য দরকার পড়ে দুজন বিচারপতি নিয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ। কিন্তু বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগে মাত্র ১৩টি একক বেঞ্চ রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে বর্তমানে ৮০ জনের বেশি বিচারপতি রয়েছেন। সরকারিভাবে হাইকোর্ট বিভাগ ছুটিতে নেই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের প্রজ্ঞাপন অনুসারে এটা পরিষ্কার নয় যে অবশিষ্ট সিংহভাগ বিচারপতি এক মাসের বেশি সময় ধরে সংবিধানের ১০৭(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘কোন কোন বিচারক কোন উদ্দেশ্যে আসন গ্রহণ’ (সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ) করেছেন বা আদৌ করেননি।

আইনজীবীদের মধ্যে ভার্চ্যুয়াল না অ্যাকচুয়াল কোর্ট এই প্রশ্নে মতভেদ আছে। কিন্তু এখনই যদি ডিভিশন বা দ্বৈত বেঞ্চ গঠন করে দেওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজন অনুসারে তাঁরা তাঁদের কার্যাবলি সমন্বয় করে নিতে পারেন। একক বেঞ্চ রুল জারি করতে পারেন না। রুল জারি করতে না পারার কারণে চূড়ান্ত রায় দিতে পারেন না। বর্তমানে রিট বেঞ্চগুলো অবশ্য সীমিতভাবে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিতে পারছেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, এমন আদেশ প্রতিপালনেও রাষ্ট্রপক্ষ সচেষ্ট হয় না। তারা অনেক ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের একক বেঞ্চের অস্থায়ী আদেশের বিরুদ্ধেও আপিল করার প্রবণতা দেখাচ্ছে। সার্বিক বিচারে আদালতের মাধ্যমে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বলবৎ করানোর ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ বেশ ক্ষুণ্ন হয়েই চলছে।

উল্লেখ্য, শুধু রিট নয়, দ্বৈত বেঞ্চ না থাকার কারণে অন্যান্য মামলারও চূড়ান্ত রায় প্রদান করা যাচ্ছে না। আরেকটি সমস্যা আগাম জামিনের দরখাস্ত নেওয়া বন্ধ থাকা। এটা চালু করতে আইনজীবীদের উদ্বেগ বোধগম্য। সুযোগ দেওয়া হলে শুধু জামিনপ্রার্থীরাও শারীরিকভাবে এজলাসে হাজির হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে আমরা শেরপুর নজিরের কথা উল্লেখ করতে চাই। সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতকে ‘হাজতি আসামির জামিনসহ জরুরি বিষয়’ নিষ্পত্তি করতে বলেছিলেন। শেরপুরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি ৩১ মে থেকে গত রোববার পর্যন্ত হাজতি আসামির চেয়ে সাধারণ আসামিদের আত্মসমর্পণের শুনানি বেশি শুনেছেন। ৪০০ হাজতি হলে ৬০০ আসামি দৈহিকভাবে শূন্য এজলাসে হাজির হন। বিচারক ও আইনজীবীরা যথারীতি ভার্চ্যুয়াল শুনানিতে অংশ নেন। শেরপুরের আইনজীবী সমিতি এ বিষয়ে সন্তুষ্ট। কারণ, এভাবে আসামিকে শারীরিকভাবে আদালতে আত্মসমর্পণের শর্ত পূরণ হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি ভালোভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে। ৬০০ আসামির মধ্যে ১০০ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক আসামিকেই কেবল জেলে যেতে হয়েছে। এটা বোধগম্য যে যা শেরপুরে সম্ভব হয়েছে, সেটা দেশের সর্বত্র সম্ভব। উচ্চ আদালতেও সম্ভব।

ভার্চ্যুয়াল কোর্ট পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার একটা চাপ আছে। এটা হবে আত্মঘাতী। সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের ই-জুডিশিয়ারি নীতির পরিপন্থী। শনিবার সুপ্রিম কোর্টের নতুন পরিপত্র বলেছে, অধস্তন আদালতে আত্মসমর্পণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দৈহিকভাবে হবে। সেটা হোক। কিন্তু যেসব স্থানের বার ও বেঞ্চ শেরপুরের মতো ভার্চ্যুয়ালি করতে চাইবে, তাদের যেন বারিত না করা হয়। পাশাপাশি দুই ব্যবস্থাই চলতে পারে।