জ্যোতিবাবু এবং ধর্মনিরপেক্ষ এক জীবন

জ্যোতি বসু
জ্যোতি বসু

আজকের মতো এত বৈদ্যুতিন চ্যানেল তখন হয়নি। একটি চ্যানেল এসেছে জ্যোতি বসুর সাক্ষাৎকার নিতে। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অবসর নিয়েছেন। প্রশ্নকর্তার জিজ্ঞাসা, কী খেতে ভালোবাসেন? অবসর সময়ে কী করেন ইত্যাদি। তাঁরা চলে যাওয়ার পর বিরক্তিসহকারে জ্যোতিবাবুর স্বগতোক্তি; যত্তসব নন–পলিটিক্যাল কোশ্চেন। এ হেন জ্যোতি বসুর আজ জন্মদিন।

রাজনীতির বাইরে কোনো আলাদা অস্তিত্ব তাঁর আছে—এটা কখনো বিশ্বাস করতেন না জ্যোতিবাবু। তাই ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইকেও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে লড়াইয়ের একটি ধাপ হিসেবে ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই স্থির করে নিয়েছিলেন। আমৃত্যু সেটির কেবল চর্চাই তিনি করেননি; বাংলা ছাপিয়ে সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত, সেটিকে অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার একটি আইকন হিসেবে গোটা জীবনের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ছাত্রজীবনে লন্ডনবাসকালেই কমিউনিস্ট মতাদর্শের সঙ্গে পরিচয় এবং আমৃত্যু বসবাস। তাই যে বয়সে ভাববাদ আর বস্তুবাদের দোলাচলে একটি তরুণ বিভ্রান্ত হতে পারে, সেই বয়সেই বস্তুবাদী দর্শনে স্থিত হতে গিয়ে জ্যোতিবাবু আত্মস্থ করেছিলেন সম্প্রীতির চেতনা। ব্রিটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল, আর তার পাশাপাশি উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক হিন্দু মহাসভা এবং উগ্র মুসলমান সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের সঙ্গে ত্রিবিধ লড়াই করে মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইই জ্যোতিবাবুকে স্থিত করেছিল ধর্মনিরপেক্ষতায়। সময়ের গতিতে কেবল স্বাধীন ভারতেই নয়, গোটা উপমহাদেশে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগের ক্ষেত্রে, নিজের দীর্ঘ সময়ব্যাপী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালকে করে তুলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার রোল মডেল।

ব্যক্তিজীবনে জ্যোতিবাবু ভাববাদের দ্বারা এতটুকু প্রভাবিত ছিলেন না। আবার নিজের বস্তুবাদী চিন্তাকে বলপূর্বক কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাজনৈতিক জীবনে, কিংবা সামাজিক জীবনে তিনি এক মুহূর্তের জন্য ও চাপিয়ে দেননি। তাঁর বাবা নিশিকান্ত বসুর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বারদীর ব্রহ্মচারীর ঘনিষ্ঠতা ছিল। একবারের জন্যও সেটা জ্যোতিবাবু গোপন করেননি, আবার সেটাকে প্রচারে এনে ধর্মীয় অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দেননি, কিংবা বাবার বিশ্বাসের সমালোচনা করে নাস্তিক মৌলবাদী হিসেবেও নিজেকে মেলে ধরেননি। একজন যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের কাছে যাপনচিত্র যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনটাই ছিল জ্যোতিবাবুর ব্যক্তিযাপন চিত্র, তেমনটাই ছিল তাঁর তাঁর দীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের গোটাটা।

একজন ধর্মান্ধের পরিচয় যেমন তাঁর ব্যক্তিজীবনে প্রথম দেখা যায়, তারপর সেটা ঘুণপোকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমাজের বুকে, তেমনি একজন যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের বোধের বিকাশের প্রাথমিক পাঠশালা হল তাঁর একান্ত নিজস্ব যাপনচিত্র।

জ্যোতিবাবুর পত্নী কমল বসু ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। একজন যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের যা করা উচিত, সামাজিক জীবনে তিনি যা করেছেন, সেটাই ব্যক্তিজীবনেও করে গিয়েছেন তিনি। স্ত্রীর ধর্মযাপনে কখনো নীরব সঙ্গী হননি। প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে খাননি। খাদ্যবস্তু হিসেবেই খেয়েছেন। আবার স্ত্রীর ধর্মাচরণ ঘিরে কখনো কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াননি। স্ত্রীর বিশ্বাসের সঙ্গে নিজে সহমত নন বলে তাঁর ঘিরে কখনো ব্যঙ্গ, উপহাসও করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঘিরে তিনি এতটাই নিস্পৃহ ছিলেন যে তাঁর গোত্র কি (হিন্দু সমাজে গোত্র প্রাতিষ্ঠানিকতায় একটা জরুরি বিষয়) জানতে চাইলে অকপটে বলেছিলেন, ‘জানি না। গোত্রফোত্র নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি।’

স্ত্রী কমল বসু তাঁর সরকারি কাজে বেলুড় মঠে যাওয়ার সঙ্গী হয়েছেন। তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরে গেছেন। সেই সময়ে জ্যোতিবাবু ব্যস্ত থেকেছেন ভরত মহারাজের সঙ্গে বিপ্লবী জীবনের স্মৃতিচারণায়। কামারপুকুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মিনি জুট মিলের উদ্বোধন করে স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যমিশ্রিত রসিকতায় একাংশের সাধুদের পোশাকের চাকচিক্য নিয়ে বলতেও ছাড়েননি।

সোমেন চন্দ খুন হওয়ার সময় ঢাকাতে আরএসপি, সুভাষচন্দ্রের সমর্থক শ্রীসংঘ, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগের চতুর্মুখী সংঘাতে মানুষের চরম দুর্দশা দেখেছিলেন জ্যোতিবাবু। দেখেছিলেন ছেচল্লিশের দাঙ্গা। সেই দাঙ্গা রুখতে কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। সম্প্রীতির স্বার্থে, কোনো রকম রাজনৈতিক ছুতমার্গ না রেখেই সতীর্থ সোমনাথ লাহিড়ীকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে। প্রকাশ্যে সোহরাওয়ার্দীকে দাঙ্গাবাজ বলে তাঁরই বাড়ির বৈঠকখানায় বসে থাকতে দেখেন শ্যামাপ্রসাদকে। তাঁকে পাত্তা না দিয়ে সোহরাওয়ার্দী জ্যোতিবাবুকে নিয়ে যান নিচের শয়নকক্ষে। মন দিয়ে শোনেন তাঁর কথা। সোহরাওয়ার্দীর এই দক্ষ প্রশাসনিক আঙ্গিক এবং দাঙ্গাবাজদের প্রতি ঘৃণার কথা জ্যোতিবাবু চিরদিন মুক্তকণ্ঠে বলতেন।

অজয় মুখার্জির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতিবাবু। হুগলীর চন্দননগরের কাছে তেলিনীপাড়ায় দাঙ্গা লাগল। দল-ধর্ম না দেখে রাজধর্ম দেখলেন জ্যোতিবাবু। পুলিশকে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, দাঙ্গাবাজ দেখলেই গুলি চালান। তার আগে বিধান রায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে ছেচল্লিশের দাঙ্গায় মুসলমান হত্যাকারী, বিধান রায় ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দুজনেরই পোষা গুন্ডা গোপাল মুখার্জি দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের সব কটি দাঙ্গায় নিজের বাহিনী নিয়ে মুসলমান খুন করেছেন। প্রশাসক জ্যোতিবাবুর ভেতর মানুষ দেখলেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রাথমিক শর্ত, সংখ্যালঘুর জানমাল নিশ্চিত করার জ্বলন্ত উদাহরণ।

ছেচল্লিশের দাঙ্গায় যে কার্যত নিজের হাতে মুসলমান কেটেছিল, সেই রাম চ্যাটার্জিকে ফ্রন্ট রাজনীতির দৌলতে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভাতে নিয়ে চলতে হয়েছিল জ্যোতিবাবুকে। গোপাল মুখার্জি যেমন বিধান রায়ের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার দৌলতে ছয়ের দশকেও কলকাতায় দাঙ্গা করেছেন, মুসলমান মেরেছেন, তাঁদের বাড়িঘর লুটতরাজ করেছেন, রাম চ্যাটার্জি কিন্তু জ্যোতিবাবুর মন্ত্রিসভায় থেকে ছেচল্লিশের পুনরাবৃত্তিসূচক একটি পদক্ষেপও নিতে সাহস করেননি।

ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণে জ্যোতিবাবুকে কখনো অভিনয় করতে হয়নি। রামকৃষ্ণ মিশনেও যে জ্যোতিবাবু, মাদার তেরেসার সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও সেই একই মানুষ, যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেমেও সেই একই জ্যোতিবাবু। ধর্মনিরপেক্ষতাকে যাপনের অঙ্গ করতে যে ধার্মিক হতে হয় না, আবার নাস্তিকও হতে হয় না, নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের ভেতর দিয়ে সেটা দেখিয়েছেন তিনি।

মাদ্রাসা শিক্ষার যেমন আধুনিকতা ঘটিয়েছিলেন তিনি তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে, তেমনি হিন্দু নয়, বিশেষ সংখ্যালঘু বলে সরকারের নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন চরম অগণতান্ত্রিক করতে চেয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন, দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে রুখেছেন জ্যোতিবাবু। যে জ্যোতিবাবু নিজের বোধে কখনো কোনো ধর্মস্থানে প্রবেশ করেননি, সেই জ্যোতিবাবুই ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিখদের ওপর যাবতীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ছুটে গিয়েছিলেন গুরুদুয়ারার ভেতরে। শিখদের প্রথাকে সম্মান দিয়ে উষ্ণীষ হিসেবে নিজের রুমালটিকেও মেলে দিয়েছিলেন মাথার ওপর।

গৌতম রায়: পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।