চিকিৎসকদের মৃত্যুর কার্যকারণ নিরূপণ জরুরি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশে করোনাকাল চলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা একধরনের ভীতির মধ্যে রয়েছেন, সংক্রমণের হারও বেড়ে চলেছে, তার সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। চিকিৎসকদের এ ভীতি থাকার কথা নয়। তাঁরা নিয়মিতভাবে যেসব রোগী দেখেন, সেসব রোগীর মধ্যে ঝুঁকিসম্পন্ন রোগীও রয়েছেন। এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, সিফিলিস—এসব রোগী দেখার বিষয়ে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই।

কিন্তু করোনা সংক্রমণের পর চিকিৎসকদের ভালো ভূমিকার প্রশংসা থাকলেও সমালোচনার অংশটি কম নয়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। কোভিড-১৯ এমন একটি অসুখ, যা সারা পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। তছনছ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থাকে। চীনের উহানে ছড়িয়ে পড়া এই অসুখে ওই প্রদেশেই মারা গেছেন অনেক চিকিৎসক। তারপর ইউরোপ, আমেরিকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসাকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যুবরণের দিক থেকেও পরিসংখ্যানের অঙ্কটা যথেষ্ট বড়।

করোনা সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারও কম নয়। প্রতিদিনই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সব খবর আসছে। এসব সংবাদ স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসক ও তাদের পরিবারকে আতঙ্কিত করেছে। জীবনের বিকাশমান ধারায় আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে সত্যি, কিন্তু তার সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ, সহানুভূতিবোধ ইত্যাদি অনুষঙ্গ অনুপস্থিত থাকছে। আমরা কেমন করে যেন হয়ে পড়ছি বিচ্ছিন্ন অসহায় সত্তারূপে।

চিকিৎসকদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে সরকারের মূল্যায়ন পরিষ্কার নয়। দায়দায়িত্বের জায়গাটায় সরকারের ভূমিকা চিকিৎসকদের কোনো মতেই নির্ভরশীল করে তুলছে না। চিকিৎসাকর্মীদের চিকিৎসার জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই। যুদ্ধে অংশগ্রহণের সঙ্গে সৈনিকদের চিকিৎসার বিষয়টিকে যেভাবে দেখা হয়, চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়, তার পরিবারের নিরাপত্তা বিষয় ভাবা হয়, আমাদের দেশে কোভিডযুদ্ধে তা নেই।

দেশের নামী, নির্ভরযোগ্য হাসপাতালে চিকিৎসকের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় না। শীর্ষ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসা শিক্ষার অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়াকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশে। দেশের ঐতিহ্যবাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্থাপিত ওয়ার্ডের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ ব্যবস্থাপনার চিত্র হতাশাজনক। চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া রোগীরা অসহায়, চিকিৎসক রোগীও অসহায়। গোলাম কিবরিয়া সাহেব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তরের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা যায়নি।

পশ্চিম বাংলার ভালো হাসপাতালগুলায় করোনাকালীন পর্বে চিকিৎসকদের জন্য কয়েকটি বিছানা সংরক্ষিত রাখা হয়। এটা করা হচ্ছে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম সুষ্ঠুরূপে সম্পন্ন করার স্বার্থে চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলে চিকিৎসকেরা পিছপা হতেন, এটা বিশ্বাস করি না। প্রথম দিকে পিপিইর কথা বলা হয়, কর্তৃপক্ষ পিপিই প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিছুদিনের ভেতরে বিভিন্ন হাসপাতালে পিপিই সরবরাহ করা হয়। পিপিইর ব্যবহার সম্পর্কে চিকিৎসকেরা শিক্ষানবিশকালে কোনো প্রশিক্ষণ পান না। পিপিই সংরক্ষণের নিয়মকানুন সম্পর্কেও তাঁদের ধারণা অস্পষ্ট।

তবুও চিকিৎসাসরঞ্জাম হিসেবে পিপিই পেয়ে চিকিৎসকেরা চিকিৎসায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। তারপর দেখা গেল সরবরাহকৃত পিপিই মানসম্পন্ন নয়, ব্যবহারের মাস্কও নিরাপদ নয়। এসব সামগ্রীর উৎস এবং তার বিতরণ নিয়ে সমালোচনা হয়। এসব শুরু হয়েছিল চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের মৃত্যুহার দেখে। চিকিৎসকেরা এসব সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহকৃত সুরক্ষাসামগ্রীর পক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের ওপর নেমে আসে শাস্তির খড়্গ। সরকারের ঘোষিত কোভিড হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসককে ওএসডি করা হয়। শোনা যায় প্রতিবাদকারী আরও অনেক চিকিৎসকের ওপর শাস্তি আরোপ করা হয়। যে সময় জানা গেল, পিপিই ‘দু নম্বরের’, এসব সামগ্রী ব্যবহারে মৃত্যুঝুঁকি কমবে না, তখনই চিকিৎসকদের ভেতর আতঙ্কের মাত্রাটা বেড়ে যায়।

কেবল কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত নয়, সব ধরনের রোগীর চিকিৎসায় ডাক্তাররা দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতা থেকে বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু করোনাভাইরাস চিকিৎসকদের দায়িত্ব পালনের ভেতরই সংক্রমণের থাবা প্রসারিত করে। এর ফলে সারা দেশের বিভিন্ন চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে সহস্রাধিক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছেন বেশ কজন প্রথিতযশা চিকিৎসক।

আবুল মোকাররিম মো. মহিউদ্দিন আমার সহপাঠী। দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গে মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেছি। মোকাররিম একজন দেশপ্রেমিক, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চিকিৎসক। সেই সুদূর জাপানে অবস্থাকালে দেশের প্রতি মমত্ববোধ উৎসারিত পত্র লিখেছিল আমাকে। ওই দেশের বিশেষায়িত চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার আলোকে আমাদের দেশের শিক্ষাজগতের পরিবর্তনের স্বপ্নের কথা ছিল তাতে। তার বিষয় রেডিওলজিতে অত্যন্ত দক্ষ এই বন্ধু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে অকালে হারাতে হলো। পিপিই পরিহিত অবস্থায় নিষ্ঠার সঙ্গে প্রফেশনাল দায়িত্ব পালন করে চলছিল সে। কিন্তু তাকে ধরে রাখা গেল না। কেবল আমার এই বন্ধু নয়, অদ্যাবধি ৬৮ জন চিকিৎসককে আমাদের হারাতে হয়েছে।

চিকিৎসকদের সামনে সুরক্ষার বিষয়টি এক জটিল প্রশ্ন হিসেবে উপস্থিত। চিকিৎসকেরা রোগীদের পাশে থেকে গভীর মমতায় চিকিৎসা প্রদান করতে পারছেন না। এই না পারায় কোনো নিরাপত্তা বোধ বা স্বস্তিবোধ নেই, বরং রয়েছে গভীর কষ্ট বোধ, দায়বদ্ধতার ক্ষত।

চিকিৎসকেরা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করছেন। এই চিকিৎসা রোগীরা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করছেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তাঁরা করোনা পরিস্থিতিতে অসহায়। বিশেষ করে যাদের সার্জারি প্রয়োজন, তারা ভয়ানক বিপদে। যারা ডায়ালাইসিসের রোগী তারাও বিপদে।

এই অসহায় অবস্থার নিরসনকল্পে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। চিকিৎসক মৃত্যুর কার্যকারণ নিরূপণ সময়ের দাবি।

অধ্যাপক ডা. মো. শফিকুল ইসলাম, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।