বিনোদন ও সাহিত্যের অর্থমূল্য এবং বিবিএসের জরিপ

জনপ্রিয়তার অর্থমূল্য কত? আদৌ কি এর অর্থমূল্য হয়? এই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ দেখে। বিনোদন ও সাহিত্যবিষয়ক সম্পদে কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ হয়, তা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে বিবিএস। গত ১২ মে তা প্রকাশিত হয়। এর আগে এই ধরনের জরিপ কখনো করা হয়নি।

জরিপের প্রেক্ষাপট বাস্তব এবং রূঢ়। সেই রূঢ় বাস্তবতা দেখে প্রথম যে বিষয়টা মাথায় এসেছে, তা হলো সৃজনশীল ও মননশীল অঙ্গনে কথাসাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার, গায়ক, অভিনেতা, পরিচালকসহ যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সৃষ্টির যতটা না অর্থমূল্য, তার চেয়ে অনেক জনপ্রিয়—যার কোনো অর্থমূল্য হয় না।

ধরুন, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কথা। জন্মসূত্রে কলম্বিয়ান হলেও তিনি সারা বিশ্বে সমান জনপ্রিয়। বিশ শতকের শেষার্ধে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও প্রভাবশালী লেখক মার্কেজ। তাঁকে জাদুবাস্তবতার পথিকৃৎ বলা হয়। মার্কেজের অন্যতম সেরা উপন্যাস হলো ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’। উপন্যাসটি লিখতে তাঁর সময় লেগেছে ১৮ মাস। এই উপন্যাস লেখার সময় তিনি সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন। উপন্যাসটি লেখার আগে তিনি ছেলেদের স্কুলে নিয়ে যেতেন। পড়াশোনা করতেন আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পানাহার করতেন।

এই ১৮ মাস সংসার কীভাবে চলছে, তা মার্কেজের অজানা। বাসাভাড়া, খাবারদাবার, সংসার সামলানো, ছেলেদের স্কুলের বেতন, বাজারসদাই, সব মার্কেজের স্ত্রী মের্সেদেস বার্চা একা সামলেছেন। এই দীর্ঘ সময় মের্সেদেস সবাইকে বলেছেন, মার্কেজ দারুণ এক উপন্যাস লিখছেন। এই উপন্যাস প্রকাশ পেলেই সবার টাকা পরিশোধ করে দেবেন। সবাই মের্সেদেসের কথা বিশ্বাস করেছে। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা।

‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’ প্রকাশ পাওয়ার পর তা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’-এর মতো আর কোনো উপন্যাস এতটা পাঠকপ্রিয়তা পায়নি। প্রশ্ন হলো, এই উপন্যাসের অর্থমূল্য কত? এর অর্থমূল্য নির্ধারণ করতে দিলে বিবিএস নিশ্চয় বইয়ের প্রোডাকশন খরচ বের করবে। যেভাবে তারা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের হিসাব করেছে। বিবিএসের জরিপে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৫৮টি সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটিতে গড়ে ৪৭ হাজার ৩৫২ টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকা।

বিবিএসের জরিপে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট সরকারি ও বেসরকারি অর্থায়নে ৬৮টি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। ওই বছর এসব সিনেমা বানাতে মোট ৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা লগ্নি করা হয়েছে।

বিবিএস যদিও এসব চলচ্চিত্র কী পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, তার হিসাব দেয়নি। ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া ৫৩টি চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অমিত আশরাফের ‘উধাও’, গাজী রাকায়েতের ‘মৃত্তিকা মায়া’ এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’।

২০১৩ সালে সাফি উদ্দিন সাফির ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ চলচ্চিত্রের আয় ছিল সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ‘মৃত্তিকা মায়া’ চলচ্চিত্রটি ১৭টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। আর ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণাধীন অবস্থায় গুটেনবার্গ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার পায়, ১৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘এশিয়ান সিলেক্ট’ ক্যাটাগরিতে সেরা ছবি হিসেবে ‘নেটপ্যাক পুরস্কার’সহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করে।

২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ৭৭টি চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তানভীর মোকাম্মেলের ‘জীবনঢুলী’, কামার আহমাদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও!’, মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’, জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ ও শাহ আলম কিরণের ‘৭১–এর মা জননী’। ‘জীবনঢুলী’, ‘মেঘমল্লার’ ও ‘৭১–এর মা জননী’ চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলোর আবেদন সব সময়।

২০১৪ সালে ইফতেখার চৌধুরীর ‘অগ্নি’ চলচ্চিত্রের আয় ছিল সর্বোচ্চ। আর ‘শুনতে কি পাও!’ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্যচিত্র উৎসব সিনেমা দ্যু রিলের ৩৫তম আসরে সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘গ্রাঁপি’ অর্জন এবং মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার হিসেবে ‘স্বর্ণশঙ্খ’ অর্জনসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সুনাম অর্জন করে।

২০১৩-১৪ সালের এই উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো দর্শক কয়েক দশক ধরে দেখবেন। এখন এত বছর ধরে চলা চলচ্চিত্রের অর্থমূল্য নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিশ্চয় বিবিএস জানে।

৩.
বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি আলাদা একটি ইতিহাস। এটি একমাত্র নাটক, যার জন্য দেশের দর্শক রাজপথে নেমেছিলেন, বাকের ভাইয়ের ফাঁসি বন্ধের দাবিতে। হুমায়ূন আহমেদের রচনায়, বরকত উল্লাহর প্রযোজনায় ১৯৯২-৯৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি প্রচারিত হয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিটিভি এই নাটক আবার প্রচার করে। এখনো এই নাটকের আবেদন কমেনি। বিশাল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিবিএস কীভাবে নাটকটির অর্থমূল্য নির্ধারণ করবে, তা নিশ্চয় তাদের জানা।

শুধু কি ‘কোথাও কেউ নেই’, অনিমেষ আইচের ‘কুফা’, মেজবাউর রহমান সুমনের ‘তারপরও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে’ নাটক দুটি দুই সময়ে নির্মিত হলেও দর্শকদের কাছে এর আবেদন এখনো সজীব। বিবিএসের কাছে না থাকতে পারে। কারণ, বিবিএস শুধু অর্থমূল্য বিচার করবে।

বিবিএসের জরিপে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সারা দেশে ১০ হাজার ৫৮১টি অনুষ্ঠান, ২৬৬টি নাটক (ধারাবাহিক ছাড়া), ৭৩টি টেলিফিল্ম নির্মাণ করা হয়। যদিও এই তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত আছে।

দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে খণ্ডনাটক, টেলিছবি ও ধারাবাহিক মিলিয়ে প্রতি ঈদে চার শতাধিক নাটক প্রচারিত হয়। (২০.৮.১৯, প্রথম আলো)

দুই ঈদ এবং পুরো বছরের হিসাবে মোট নাটকের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। সব মিলিয়ে অর্ধেক ধরে শুধু খণ্ডনাটকের সংখ্যা হিসাব করলেও বিবিএসে হিসাবের সঙ্গে মেলে না।

মজার তথ্য হলো টেলিভিশন নাটক, টেলিফিল্ম, ডেইলি সোপ, টক শো, শিক্ষামূলক ও অনুসন্ধানী অনুষ্ঠানগুলোর বড় দর্শকই হলেন প্রবাসী শ্রমিকেরা। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশের বিনোদনমাধ্যমের সব আপডেট রাখেন। তা হোক অনুষ্ঠান বা নাটক। বিশাল প্রবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকসংখ্যক শ্রমিকও যদি এক টাকা করে দেন, তাহলে ৬৫ লাখ টাকা আয় হয়। বিবিএসের কাছে এই তথ্যও নিশ্চয় থাকবার কথা।

৪.
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সৃজনশীল ও মননশীল মাধ্যমটি বেশ নড়বড়ে অবস্থানে আছে। এই কঠিন সত্যটা আমাদের মেনে নিতেই হবে। বিবিএস বিনোদনের সব ক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ দিয়েছে। ভারতের বিনোদনমাধ্যম যে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশ কি সেই জায়গায় যেতে পেরেছে? না পারার কারণ অসংখ্য। সেসব কারণ কারও নজর নেই। নজর শুধু অর্থের দিকে।

আমার বক্তব্য সরল, বিবিএস যে প্রক্রিয়ায় অর্থমূল্য বা লাভ নির্ধারণ করেছে, প্রক্রিয়াটি সঠিক নয়। একটি কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র দেখা বা পড়া হয় দশকের পর দশক। এই যে এত বছর ধরে তা চলছে, তার অর্থমূল্যের কোনো নির্দেশনা বিবিএসের জরিপে ছিল না। ছিল শুধু ক্যালকুলেটরের হিসাব-নিকাশ। এই হিসাব-নিকাশকে ছাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীল ও মননশীল মাধ্যম।

বিনয় দত্ত: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]