শরণার্থীরা এখন সবার মনোযোগের বাইরে

রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান তাই পূর্ণ মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। ছবি: রয়টার্স
রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান তাই পূর্ণ মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বলপূর্বক বিতাড়নের তিন বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। তিন বছরে এ নিয়ে দেশ–বিদেশের পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই নির্যাতিত বিপুল জনগোষ্ঠীর নিজ বাসভূমে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে এ সময়ে কোনোই অগ্রগতি হয়নি। এর মধ্যে বৈশ্বিক মহামারি করোনা এমনভাবে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যা এখন সংবাদমাধ্যমের স্থান দখল করে রেখেছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম থেকেও এ ভাগ্যাহত মানুষগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে।

কয়েক দফা দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, একটি অসম চুক্তি, কিছুসংখ্যক পরিবারকে ফেরত পাঠানোর অসফল প্রয়াস—এসব পর্যবেক্ষণ সবই বাসি হয়ে গেছে। ধারাবাহিক আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, কোভিড–১৯ সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে তা-ও পিছিয়ে গেছে। নতুন কোনো তারিখও ঠিক হয়নি।

তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে শরণার্থী সমস্যার তিনভাবে সমাধান হতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা আবার স্বদেশে ফেরত যেতে পারে, যেমন মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসেছিল। সমাধানের দ্বিতীয় উপায়, উদ্বাস্তুদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসন করা। সাম্প্রতিক সময়ে এমনটি ঘটেছে শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে তুর্কি বা গ্রিসে পালিয়ে যাওয়া বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুর ক্ষেত্রে—তারা প্রধানত জার্মানি এবং অল্প সংখ্যায় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় লাভ করেছে।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কিন্তু এটা ঘটেনি। তুরস্ক, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি শুধু তাদের জার্মানি যাওয়ার পথ ছেড়ে দিয়েছিল। জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল এ চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করেছেন। মানবিকতার সুনাম অর্জন ছাড়াও একটি বাস্তব সুবিধা হয়েছে জার্মানির। স্বল্প জন্মহারের ফলে দেশটি ডেমোগ্রাফিক সমস্যার সম্মুখীন। প্রধানত তরুণ বয়সের এই অভিবাসীদের কারণে জার্মানির কর্মক্ষম জনসংখ্যার সংকট অন্তত ৩০ বছর পিছিয়ে যাবে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমের দেশগুলো আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, কিন্তু সমাধানের এ পথে এগোবে—তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

সমাধানের তৃতীয় পদ্ধতি আশ্রয় গ্রহণকারী দেশে স্থানীয়ভাবে উদ্বাস্তুদের আত্তীকরণ। সাম্প্রতিক কালে এমন বড় কোনো উদ্বাস্তু গোষ্ঠীর এ ধরনের আত্তীকরণের কোনো উদাহরণ নেই। তা ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশে এমন বড়সড় একটি জনগোষ্ঠীর স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের ধারণা একাধারে অবাস্তব ও অযৌক্তিক। দুর্ভাগ্যক্রমে, দেশে ও বিদেশে কেউ কেউ এ বিপজ্জনক ধারণাকে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে নীরবে প্রচারের চেষ্টা করছেন। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন ও সজাগ থাকা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র স্থায়ী সমাধান তাই পূর্ণ মানবিক মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা স্পষ্টভাবেই বলেছেন। এর বাইরে অন্য কোনো সমাধান খোঁজা হবে নিতান্তই গণহত্যাকারীদের তুষ্ট করার নামান্তর, যা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সেই সঙ্গে মিয়ানমারে যারা জাতিগত নিধন অভিযান চালিয়েছে, তাদেরও অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হতে অনুপ্রাণিত না হয়।

শেষোক্ত বিষয়ে দুটি ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বিগত বছরে, যা আমরা জানি। গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দুটি মামলা চলমান আছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। তবে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগবে, আর তাতে মিয়ানমার দোষী সাব্যস্ত হলেই যে রোহিঙ্গারা তাদের বাসভূমে ফেরত যেতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।

সংকটের শুরু থেকেই বাংলাদেশ এর শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। এ লক্ষ্যে এমনকি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। এ কায়দায় সমাধান সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় হয়েছে। প্রথমত, ইতিহাসের দিকে তাকালে এর কোনো ইতিবাচক উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। অপরাধীদের পরাজয় এবং শাস্তিবিধান ছাড়া এ ধরনের কোনো সমস্যা সমাধান অতীতে হয়নি। অবশ্য অতীতে হয়নি বলেই যে ভবিষ্যতে হবে না, এমন কথাও নেই। তবে তা হতে হলে একটি মৌলিক শর্ত পূরণ করতে হবে। তা হচ্ছে মিয়ানমারের রাষ্ট্র এবং সমাজকে শর্তহীনভাবে মেনে নিতে হবে যে যুগ যুগ ধরে রাখাইনে বাস করে আসা রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক এবং সমাজের বাকি মানুষের মতো তাদেরও অধিকার আছে পূর্ণ মর্যাদা, নিরাপত্তা, অধিকারসহ সেখানে বাস করার। মূল সমস্যাটা এখানেই। বরং এর উল্টোটাই ঘটেছে মিয়ানমারে। আইন করে বরং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে রাষ্ট্র।

বিগত কয়েক দশকে এশিয়ার বিভিন্ন সমাজে একটি নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কট্টর বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এবং বৌদ্ধ পুরোহিত শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড এ জ্বরে বেশি আক্রান্ত। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও বিতাড়নে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং একনিষ্ঠ দোসর দেশটির বৌদ্ধ পুরোহিত শ্রেণি। এই পুরোহিতেরা শুধু যে এ নৃশংসতা সমর্থন করেছেন তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে এবং তাদের বিতাড়নে উদ্বুদ্ধ করতে তাঁরা কার্যকর ভূমিকাও রেখেছেন। সাধারণ মানুষ এবং সিভিল সমাজও এ ক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। অর্থাৎ, মিয়ানমারের রাষ্ট্র ও সমাজে একটি বিষাক্ত রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে, যা এ গণহত্যা ও বিতাড়ন সমর্থন করে এবং চায় না যে কখনো তারা ফিরে আসুক। তাদের এ মনোভাবের প্রতি চীন, জাপান, ভারত এবং আসিয়ান দেশগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন গণহত্যাকারী মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং মিয়ানমার রাষ্ট্রকে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে তুলে দিয়েছে।

চাপের মুখে বাধ্য না হলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার কোনো ইচ্ছা মিয়ানমারের নেই, এটা খুবই স্পষ্ট। তবে যে ধরনের চাপ মিয়ানমারকে এ কাজে বাধ্য করতে পারে, তেমন কিছু করার ইচ্ছা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে স্পষ্টতই অনুপস্থিত।

রোহিঙ্গা সমস্যার শিগগিরই কোনো সমাধান হচ্ছে না, এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত। আজ থেকে ১০ বছর পরের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করা যাক। উচ্চ জন্মহারের কারণে বর্তমান বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোরের সঙ্গে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শিশু সেখানে যোগ দেবে। এর মধ্যে কিছু হবে মানব পাচারের শিকার, কিছু লুকিয়ে-চুরিয়ে বাংলাদেশের জনস্রোতে মিশে যাবে। আর বেশির ভাগ হবে একটি অসন্তুষ্ট, পথভ্রষ্ট, বিস্ফোরণোন্মুখ তারুণ্যের অংশ, যে তারুণ্য আশাহীন, অন্তহীন সুড়ঙ্গে নিজেদের অবস্থানকে মেনে নেবে না। এই তারুণ্যকে প্রত্যাশার আলো দেখাতে না পারলে তাদের শক্তি ধ্বংসাত্মক পথে ধাবিত হবে, যার ফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা দৃশ্যতই সুদূরপরাহত। কূটনৈতিক প্রয়াসের পাশাপাশি তাই আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘প্ল্যান বি’ থাকতে হবে এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকে।
আজ থেকে ১০ বছরের মাথায় বিপুলসংখ্যক আশাহত রোহিঙ্গা তরুণ যদি সহিংস হয়েই ওঠে, তবে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। গণহত্যার শিকার একটি জনগোষ্ঠী এমন পথ বেছে নিতেই পারে। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী হবে, সে চিন্তাভাবনা আমাদের থাকতে হবে।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব