প্রাচীন ডিএনএর জন্য বাংলাদেশিরা কোভিড-১৯-এ বেশি ঝুঁকিতে?

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক/সাংবাদিক কার্ল জিমারের একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর হার অন্য দেশ বা জাতির থেকে বেশি হওয়ার পেছনে প্রাগৈতিহাসিক ‘ডিএনএ’ জড়িত। এটি খুব সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেরিয়েছে, তবে এখনো সমর্থিত নয়। গবেষণাপত্রটি সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হব হব করছে। এই নিয়ানডার্থাল জেনোমের অংশটি মানুষের ক্রোমোজম-৩-এর ৬টি জিনজুড়ে রয়েছে। এর উৎপত্তি কবে হয়েছে, সেটা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ‘সংখ্যা গণনার অতীত প্রত্যুষে’।

কেন হঠাৎ ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের বিষয়টি এল? সেটার কারণ খুব সম্ভবত যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ মৃত্যুহার নিয়ে গবেষণা। জুনের ১৯ তারিখে ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ ‘South Asians in Britain most likely to die in hospital of Covid-19, study finds’ (গবেষণা জানাচ্ছে ব্রিটেনের দক্ষিণ এশীয়দের কোভিড-১৯-এ হাসপাতালে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি) শিরোনামে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেটা নিয়ে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মৃত্যুহার অন্য দেশের বংশোদ্ভূত লোকজনের চেয়ে প্রায় ২০ ভাগ বেশি। অন্য সবকিছু একই রকম থাকার পরও এই সংখ্যাধিক্যের কারণ খুঁজতে নানান গবেষণা হচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাস যে বয়স, লিঙ্গ, এমনকি জাতিভেদে কম বা বেশি প্রাণঘাতী হতে পারে, তা এত দিনে প্রায় সবাই জেনে গেছেন। দেখা গেছে, নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুহার বেশি। শিশুদের সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার অনেক কম। এমনকি জাতিভেদেও রোগের লক্ষণ কম বা বেশি গুরুতর হচ্ছে। বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। কিছু কিছু রোগ আছে নির্দিষ্ট জাতির মানুষের মধ্যে বেশি বিস্তার করে। যেমন ‘সিকল সেল ডিজিজ’ আফ্রিকান ও মেডিটেরেনিয়ানদের মধ্যে বেশি, ‘সিস্টিক ফাইব্রোসিস’ রোগটি ইউরোপীয়দের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

তবে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর জুলাইয়ের ৪ তারিখে প্রকাশিত ‘DNA Linked to Covid-19 Was Inherited From Neanderthals, Study Finds’ (কোভিড-১৯-এর সঙ্গে সম্পর্কিত ডিএনএ নিয়ানডার্থালদের থেকে আসা) আর্টিকেলটি প্রায় অবিশ্বাস্য। যাঁরা নিয়ানডার্থাল প্রজাতির নাম কখনো শোনেননি, তাঁদের জন্য তো বটেই। বিষয়টি নিয়ে যে গবেষক গবেষণা করেছেন, তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজননবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ (geneticist )। তাঁর নাম জোশুয়া আকে।

আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স’ (Homo Sapiens Sapiens)। আদি প্রজাতিটির নাম গবেষকরা বলছেন ‘হোমো সেপিয়েন্স’ (এখানে সেপিয়েন্স শব্দটি একবার)। তা থেকেই আধুনিক মানুষ এবং তার কয়েকটি উপ-প্রজাতির জীবাশ্ম পাওয়া গেছে, যারা সবাই বহু সহস্র বছর ধরে বিলুপ্ত। এমন একটি উপ-প্রজাতির নাম ‘হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস’ (Homo Neanderthalensis), সংক্ষেপে নিয়ানডার্থাল। আরেকটি প্রধান উপ-প্রজাতি রয়েছে ‘ডেনিসোভানস’। আদিতে তারা সব এক ছিল, একটি গাছের শাখার মতো। তারপর প্রশাখা হিসেবে আলাদা হয়েছে। আধুনিক মানুষের উৎপত্তি আফ্রিকা থেকে—গবেষকেরা বলছেন প্রায় দুই লাখ বছর আগে। আধুনিক বলতে জামা-জুতো পরা মানুষ নয়, শারীরিক গঠনে সম্পূর্ণ এখনকার মতো মানুষ বোঝানো হয়েছে (anatomically modern)।

আফ্রিকা থেকে ৭০ হাজার বছর আগে কোনো এক ভয়াবহ অজানা দুর্যোগের কারণে তারা ইউরোপে, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ওসব জায়গায় চলছে নিয়ানডার্থালের যুগ। তারা পরস্পরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। নৃতত্ত্ববিদরা বলছেন, প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে নিয়ানডার্থালরা সম্ভবত মানুষের পূর্বপুরুষদের কাছে পরাজিত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এই তথ্য অনেকেরই জানা যে ‘হিউম্যান জেনোম প্রজেক্ট’ শুরু হয় ১৯৯০ সালে, শেষ হয় ২০০৩ সালে। এতে মানুষের সব ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা হয়। ২০০৬ সালে শুরু হয় নিয়ানডার্থাল জেনোম প্রজেক্ট, যেটাতে বিলুপ্ত নিয়ানডার্থাল প্রজাতির ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার ভিন্দিজা গুহা থেকে পাওয়া প্রায় ৩৮ হাজার বছর আগের নারী নিয়ানডার্থালের ঊরুর হাড় এবং স্পেন, রাশিয়া ও জার্মানি থেকে প্রাপ্ত কিছু প্রাচীন নিয়ানডার্থাল দেহাবশেষের হাড় থেকে সংগ্রহ করা হয় তাদের ডিএনএ। সেই প্রজেক্ট শেষ হয় ২০০৯ সালে। জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক গবেষণাকেন্দ্র প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে ২০১০ সালে। পরে ২০১৩ সালে সাইবেরিয়ার এক গুহা থেকে প্রাপ্ত ৫০ হাজার বছরের পুরোনো নিয়ানডার্থাল হাড়ের টুকরা থেকে আরও ভালো ডিএনএ উপাত্ত পাওয়া যায়। এসব উপাত্তের সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নিয়ানডার্থালের জেনোমের সন্ধান মেলে। ধারণা করা হচ্ছে, মানুষের পূর্বপুরুষ ও নিয়ানডার্থালের মধ্যে মিলনের মাধ্যমে একের ডিএনএ অন্যের মধ্যে মিশ্রিত হয়েছে। সেটা ঘটেছে প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে।

কী পরিমাণ নিয়ানডার্থাল ডিএনএ একজনের শরীরে রয়েছে, সেটা আবার তার জাতির (race) ওপর নির্ভর করছে। আফ্রিকানদের মধ্যে একেবারেই নেই। কারণ হয়তো আফ্রিকায় নিয়ানডার্থাল ছিল না, তারা ছিল ইউরোপ-এশিয়ায়। কিন্তু ইউরোপ-এশিয়ার মানুষদের মধ্যেও জাতিভেদে এর পরিমাণ কম-বেশি হচ্ছে কেন; সেটির সদুত্তর মেলেনি।

এই নিয়ানডার্থাল থেকে প্রাপ্ত ডিএনএগুলো মানুষের কী কী বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করছে, সেটা নিয়ে গবেষণা চলছে। ডিএনএর মধ্যে মূলত প্রোটিন তৈরির কোড বা সংকেত থাকে। ডিএনএ প্রোটিন সংশ্লেষণ করে। ডিএনএ-ই মানুষের উচ্চতা, ত্বকের বর্ণ, চুল ও চোখের রং থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি শারীরিক বৈশিষ্ট্যই অনেকখানি নির্ধারণ করছে, সঙ্গে কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্যের কারণও ডিএনএর মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে। ডিএনএ সময়ে, সুযোগে এবং পরিবেশে, একটি জীবের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় (expressed)। কিন্তু সব ডিএনএ প্রকাশিত হয় না। অনেক ডিএনএ আছে তার মধ্যে কোনো সংকেত নেই, সেগুলোকে বলে ‘জাঙ্ক’ (junk) বা অপ্রয়োজনীয় ডিএনএ। নিয়ানডার্থাল ডিএনএর অধিকাংশই মানুষের জন্য ‘জাঙ্ক’ ডিএনএ।

‘জাঙ্ক’ ডিএনএ নামটি অনেক আগের। ১৯৭২ সালে জাপানের প্রজননবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ সুসুমু ওনো এই কথাটি প্রবর্তন করেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, এই ডিএনএগুলোও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে। তারা আসলে অপ্রয়োজনীয় নয়।

যা হোক, মানুষের মধ্যে অন্তত দুটো বৈশিষ্ট্য নিয়ানডার্থাল জেনোমের অংশবিশেষের কারণে প্রকাশিত (expressed) হতে পারে বলে গবেষকেরা মনে করছেন। একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটা ডিপ্রেশন বাড়াতে পারে। আরেকটি হলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে।

ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা মানুষের পূর্বপুরুষদের থেকে নিয়ানডার্থালদের বেশি ছিল। কারণ তারা এই অঞ্চলে মানুষের পূর্বপুরুষদের আগমনেরও হাজার হাজার বছর আগে থেকেই বসবাস করে আসছিল। কাজেই ক্রমে ক্রমে তাদের দেহ তখনকার ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিল। নিয়ানডার্থালের এই ভাইরাস প্রতিরোধক্ষমতাটি কোনো কোনো মানুষের ক্রোমোজম-৩-এর ৬টি জিনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিষয়টি ভালো। বলা হচ্ছে, সে কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। তবে নভেল করোনাভাইরাসের যুগে সেটাই আবার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভাইরাস সেই ৪০ হাজার বছর আগের আদিম ভাইরাসের জাত নয়। অথচ যাদের শরীরে নিয়ানডার্থাল জিনের প্রকরণটি (variant ) রয়েছে, তাদের অত্যধিক ভাইরাস প্রতিরোধক্ষমতা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে এত বেশি সক্রিয় করে তুলছে যে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ভাইরাস যেহেতু নতুন, সেহেতু কাজের কাজ হচ্ছে না। মধ্যখানে প্রতিরোধই অসুখের প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেমনটি এলার্জির ক্ষেত্রে হয়।

গবেষক জোশুয়া আকের উদ্ধৃতি দিয়ে কার্ল জিমার বলছেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লোকজনের মধ্যে শতকরা ৬৩ জনের মধ্যে ক্রোমোজম-৩ এর এই নিয়ানডার্থাল থেকে আসা জিনের অন্তত একটি কপি রয়েছে। যদি দুটি কপি থাকে, তাহলে নভেল করোনাভাইরাস আক্রমণের ফলাফল খুব গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা যার একটিও নেই, তার থেকে তিন গুণ বেড়ে যায়।

শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের এক-তৃতীয়াংশের মধ্যেও ক্রোমোজম-৩-এর সেই প্রকরণটি রয়েছে। তবে পৃথিবীর অন্য অঞ্চলে এই নিয়ানডার্থালপ্রসূত জিনের প্রকরণ অনেক কম। যেমন ইউরোপে মাত্র ৮ শতাংশ, পূর্ব এশিয়ায় ৪ শতাংশ এবং আফ্রিকায় শূন্যের কোঠায়। নিয়ানডার্থাল জেনোম প্রজেক্টের প্রধান গবেষক ড. পাবোর উদ্ধৃতি দিয়ে কার্ল জিমার তাঁর আর্টিকেলে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লোকজনের কোভিড-১৯-এ মৃত্যু হার বেশি হওয়ার জন্য সম্ভবত নিয়ানডার্থাল ডিএনএর এই বিশেষ অংশটিই দায়ী।

তবে কী কারণে আফ্রিকার বাইরে পৃথিবীর কিছু জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ানডার্থাল ডিএনএ কম, কিছু জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বেশি, সেটা এখনো কেউ সঠিক বলতে পারছেন না। সে জন্য প্রাচীন মানুষের জীবাশ্ম নিয়ে প্রচুর গবেষণা করা প্রয়োজন হবে।

মোস্তফা তানিম: বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।