ব্যাংক খাতে একীভূতকরণ কি আসন্ন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ থেকে ১০০ বছর আগে ব্যাংকের সংখ্যা ছিল এখনকার প্রায় তিন গুণ। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ছিল প্রায় ১৮ হাজার। ১৯২৮-১৯৩৩ সালের মহামন্দার শেষে নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। তারপর অনেক বছর আর কমেনি। ২০০৭-০৯ সালের মন্দার পরে আবারও অনেক কমে যায়। এখন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকের সংখ্যা ৫ হাজার ১৭৭। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যাংকের দেশ। দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি, তৃতীয় স্থানে আছে জাপান। এই দেশগুলোসহ অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি আরও ২৬ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে।

প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ অর্থনীতিতে ব্যাংকের সংখ্যা কমার আদৌ কি কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, ছিল। প্রথম কারণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা। মহামন্দার কারণে মানুষের উপার্জন ক্ষমতা কমে যায়, সঞ্চয় ব্যাহত হয়। এ কারণে আমানতকারী ব্যাংকে আমানত না রাখতে পারায় ব্যাংক অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হয়। এ জন্য আয়, মুনাফা কমতে থাকায় অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় কারণটি অন্য রকম। ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক খাত সংস্কারের জন্য ‘গ্রাম-লিচ-ব্লিলে আইন’ (The Gramm-Leach-Bliley Act.)’ পাস হয়। এ আইনের সাহায্যে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবসায়িক ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়। যেমন আইনটি পাসের আগে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের কর্মপরিধি ভিন্ন ভিন্ন ছিল। নতুন আইনে এই ভাগ তুলে দেওয়া হয়। ফলে উভয় ধরনের ব্যাংক একে অপরের সঙ্গে একীভূত হয়। এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করে। এভাবে আইনটি পাস হওয়ার অল্প পরেই, চলতি শতকের গোড়ার দিকে আমেরিকায় ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কমে

তৃতীয় কারণটি নিকট অতীতের বিশ্ব অর্থনীতিতে অর্থায়ন সংকট। সংকটের শুরু ২০০৮ সালে, যখন আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান লেহমান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে যায়। ওই সংকট সারা বিশ্বের অর্থনীতিতেও দীর্ঘমেয়াদি সংকট বয়ে আনে; অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতিযোগিতা বেশি থাকলে প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র কমে যায়। মুনাফা বিঘ্নিত হলে দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে পারে না। বাজার অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকে মুনাফা অর্জনের জন্যই। সুতরাং, শিল্প খাতের ধরন ও পরিচালনা পদ্ধতি ওই খাতের মুনাফা অর্জনের সক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। অর্থনীতিবিদ হার্শম্যান ও হারফিন্ডাল উদ্ভাবিত এবং তাঁদের নামানুসারে প্রচলিত ‘এইচ এইচ সূচক’ কোনো শিল্প খাতে বিরাজমান প্রতিযোগিতা পরিমাপের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। এই সূচক অনুযায়ী একটি রেফারেন্স মান ধরা হয়। রেফারেন্স মান অনুযায়ী প্রচলিত শিল্পটির কাঠামো কী ধরনের, সেখানে প্রতিযোগিতা কোন পর্যায়ের, তা সহজে বোঝা যায় এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ কোনো শিল্পে ‘এইচএইচ’ সূচক মান যদি ১৫০০ থেকে ২৫০০–এর মধ্যে থাকে তবে শিল্প খাতটিকে মোটামুটি প্রতিযোগিতামূলক বলা হয়। আর সূচকের মান ২৫০০–এর ওপরে হলে তাকে পুঞ্জীভূত বাজার বলে, যেখানে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই প্রতিযোগিতার সক্ষমতা খুবই কম। সে রকম বাজারব্যবস্থায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অতি সক্ষমতার কারণে অন্য ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো টিকতে পারে না। সূচক মান ১৫০০–এর নিচে হলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কিছু প্রতিষ্ঠান নির্মূল হয়ে যায়, কিছু বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা কী? উত্তর খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। ‘এইচএইচ’ সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অতি প্রতিযোগিতামূলক। এর ‘এইচএইচ’ সূচক মান ১৩০০–এর কাছাকাছি। এটা একটু বেমানানই বটে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ ব্যাংক সেবার আওতাভুক্ত। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে আরও হতাশার চিত্র বেরিয়ে আসবে। কারণ, এই ২০ থেকে ২৫ ভাগ জনসংখ্যার সবাই ব্যাংকে নিয়মিত লেনদেন করে না। যারা নিয়মিত লেনদেন করে, তাদের অনেকে ব্যাংকের কাছে লাভজনক গ্রাহক নাও হতে পারে। এ দেশে এখন ৬০ থেকে ৬৫টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠান আছে। বাণিজ্যিক বিবেচনায় সংখ্যাটি বেশিই বটে।

ভারতে সম্প্রতি ব্যাংক খাতের একীভূতকরণ সম্পন্ন হয়েছে। সে দেশে ২০১৭ সালে সরকারি খাতে ব্যাংক ছিল ২৭টি, ২০২০ সালে এসে সেগুলো ১০টি ব্যাংকে একীভূত হয়েছে। ভারতের ব্যাংক খাতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের যথেষ্ট মিল আছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই ব্যাংক রয়েছে। রাষ্ট্র খাতের লোকসানি ব্যাংকে জনগণের বা সরকারি অর্থায়ন সম্ভব হলেও বেসরকারি ব্যাংকে সে সুযোগ নেই। এমনিতেই রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকে সরকারিভাবে অতিরিক্ত মূলধন সরবরাহ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।

কোভিড মহামারি পরের বিশ্ব অর্থনীতি নিঃসন্দেহে মন্দার দিকে যাবে। প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখিতার পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানও কমে যাবে। আমাদের দেশে কোভিডের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব প্রকট হতে শুরু করেছে। এই ধারা চলতে থাকলে এর ব্যাংক খাতের ওপরও অবশ্যই পড়বে। আমাদের ব্যাংকিং খাত ইতিমধ্যেই অতি প্রতিযোগিতামূলক। এসব বিবেচনায় অদূর ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর একীভূত হওয়ার পথে যেতে হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

শহীদুল জাহীদ: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়