করোনাকালে নারী ও কিশোরীদের বাড়তি ঝুঁকি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজ ১১ জুলাই, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ২০২০ সালে দিবসটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পালন করা হচ্ছে। গত ছয় মাসে কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বের মানুষের জীবনযাত্রার সব পর্যায়েই প্রভাব বিস্তার করেছে কিংবা করছে। বাংলাদেশে করোনার বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যেই লক্ষ যাচ্ছে, যার অধিকাংশই জনসংখ্যা সংক্রান্ত। জনসংখ্যা বিজ্ঞানে জন্ম, মৃত্যু ও স্থানান্তর—এই তিন পর্বকে বলা হয় মৌলিক জনমিতিক প্রক্রিয়া। করোনা তিনটি প্রক্রিয়াকেই প্রভাবিত করছে।

কোভিড-১৯ আমাদের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ ঘনবসতির বিচারে বিশ্বে শীর্ষে। প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। সংক্রমণের চূড়া বা পিক সময় নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। ইতিমধ্যে শনাক্ত মানুষের চেয়ে শনাক্ত হননি বা পরীক্ষা করাতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বলে ধারণা করা যায়। এ সময়ে জনসংখ্যার বিভিন্ন উপগোষ্ঠী কিংবা প্রান্তিক মানুষেরা অধিকতর ঝুঁকি ও আনুষঙ্গিক সমস্যায় রয়েছেন। নারী ও কিশোরীরা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

এ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করি: নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’। সুরক্ষাহীন নারী ও কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার নিশিচত করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে কীভাবে তাদের অধিকতর সুরক্ষা দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবনা ও যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা এবং আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আইসিপিডি) ২৫ বছর পূর্তির প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ভিত্তিমূলে যেন থাকে অধিকার ও পছন্দ, সমতা ও জীবনের গুণগত উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে তিনটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো মাতৃমৃত্যুর হার, পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা এবং যৌন সহিংসতা, নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে শূন্যে নামানো। এগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে অ্যাজেন্ডাভিত্তিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। চলমান কোভিড–১৯ মহামারিতে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের অর্ধেকের বেশির বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। প্রায় প্রতি তিনজন কিশোরীর একজন এখনো গর্ভধারণ করে ২০ বছরে পৌঁছানোর আগেই। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ (২০১৭-২০১৮) তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালের পর থেকে দেশের মোট প্রজনন হার কমানোর ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। বিভাগ কিংবা অঞ্চলভেদে প্রজনন হারে বেশ পার্থক্য রয়েছে। সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এলাকায় প্রজনন হার বেশি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের হারেও অগ্রগতি ঘটেনি। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদার হার ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখনো মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি। আগামী সাড়ে ৯ বছরে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাতৃমৃত্যু প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ৭০–এ নামিয়ে আনা বাংলাদেশের জন্য এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। কোভিড–১৯ মহামারির সময়ে প্রজননস্বাস্থ্যসেবা বাধার সম্মুখীন। দেশব্যাপী লকডাউন (সাধারণ ছুটি) ও তা বাস্তবায়নে ঘাটতি, করোনাসংক্রান্ত সামাজিক ভীতি, পর্যাপ্ত জনবলের অভাব এবং সেবা প্রদানকারী ও সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্ভূত বিরূপ পরিস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সেবা ব্যাহত হলে, প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা নিশ্চিত করা না গেলে, সঠিক সময়ে শিশুদের টিকা দেওয়া না গেলে জন্মহার, মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউনিসেফ প্রকাশিত (৭ মে ২০২০) এক প্রক্ষেপণ ফলাফল বলছে, মহামারির প্রেক্ষাপটে ১১ মার্চ থেকে আগামী ৯ মাসে লকডাউন পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশে ২৪ লাখ শিশু জন্ম হতে পারে। অপ্রত্যাশিত সন্তান জন্মদানে বাংলাদেশ বিশ্বে নবম স্থানে রয়েছে। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমে লক্ষ করা যাচ্ছে করোনাকালে বাল্যবিবাহ ও গৃহে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে।

তা ছাড়া অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত নারীদের মধ্যে এখন দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে করোনাকালে ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাল্যবিবাহ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, কিশোরী মাতৃত্ব, উচ্চ মাতৃমৃত্যু হার, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা, পরিবারে সহিংসতার শিকার হওয়া, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয় ও পরিবর্তিত বিশ্ববাজারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া ইত্যাদি। তবে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার ও তা সবার জন্য সহজলভ্য না হওয়া পর্যন্ত অধিকতর সুরক্ষাহীন নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা ও অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

এ সংকটকালে দরকার বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রাখা, সেবার সঠিক মূল্যায়ন ও কার্যকর সেবা প্রদান বা সেবা গ্রহণে সার্ভিস প্রদান কার্যক্রম পর্যালোচনা করা, নতুন চাহিদার পরিসরে সুরক্ষা দেওয়া। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রস্তুতি জোরদার করা, নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খুঁজে বের করা ও বহুমুখী পরিকল্পনা করে অগ্রসর হওয়া।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
[email protected]