সাহেদ-শহিদ উপাখ্যান ও আমজনতা

জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় কুয়েতে গ্রেপ্তার সাংসদ শহিদ ইসলামের প্রসঙ্গ একাধিকবার এসেছে। বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ জানতে চাইলেন কুয়েতের নাগরিক শাহিদ ইসলাম কী করে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য থাকেন? জবাবে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, তিনি কুয়েতের নাগরিক হয়ে থাকলে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্যপদ থাকবে না।

শহিদ ইসলাম নিজেও বলেননি তিনি কুয়েতের নাগরিক। কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম নিরাপত্তা বিভাগ বলেছে, কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযুক্ত বাংলাদেশি সাংসদ কুয়েতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা সত্য নয়। তিনি বিদেশিদের জন্য আবাসিক আইনের আওতায় কুয়েতে বসবাস করছেন। বাংলাদেশের একজন সাংসদ অর্থ ও মানব পাচারের দায়ে বিদেশি কারাগারে আটক আছেন। তাঁর অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হিসেবে যেসব কুয়েতি নাগরিকের নাম এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছে দেশটি। কুয়েতের জাতীয় সংসদে তাঁকে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। দেশবাসী আশা করেছিল, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদেও তাঁকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। এর সঙ্গে জড়িত দেশের মান–সম্মানের প্রশ্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও বলেছেন, তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে শহিদ ইসলামের নির্বাচিত হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে। বিষয়টি এত সরল নয় যে আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী সরে দাঁড়ানোয় তিনি ফাঁকতালে নির্বাচিত হয়েছেন। এর নেপথ্যে অনেক ‘খেলা’ ছিল। শহিদ ইসলাম আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু সেই মনোনয়ন না দেওয়া ব্যক্তির পক্ষে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি চিঠি দিয়ে স্থানীয় নেতা–কর্মীদের তাঁর পক্ষে কাজ করতে বলার পেছনে কী রহস্য ছিল। নির্বাচনের আগে তিনি আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেই বৈঠকে কী কী আলোচনা হয়েছে, সেসবও গণমাধ্যমে এসেছে। এলাকার মানুষ জানে কী হয়েছিল নির্বাচনের আগে।

সাংসদ শহিদ ইসলাম ও রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ সাহেদের মধ্যে যথেষ্ট মিল আছে। দুজনই একসময় বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন দুজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। দুজনই দেশের ভাবমূর্তি ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। একজন বিদেশি কারাগারে আটক মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে। আরেকজন দুটি হাসপাতালের মালিক হয়ে করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে হাজার হাজার ভুয়া সনদ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে তাঁর চুক্তি ছিল তাঁর হাসপাতালটি বিনা মূল্যে রোগীদের করোনা পরীক্ষা করবে এবং চিকিৎসা দেবে; ব্যয় বহন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়েছে। ১০ হাজারের বেশি মানুষকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সনদ দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৬ হাজার ভুয়া। নমুনা পরীক্ষা না করেই সনদ দিয়েছে। করোনা–আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ এবং সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত বলে সনদ দিয়েছে। ভাবা যায়, একজন করোনা আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ বলে ঘোষণা দেওয়ার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে? এর ফলে ওই ব্যক্তি কোনো চিকিৎসা নেননি এবং যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঘরে-বাইরে তিনি যাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, তাঁদের মধ্যেও ভাইরাসটি ছড়িয়েছেন।

রিজেন্ট হাসপাতালের সনদ কেলেঙ্কারি করে দেশকেও বিপদে ফেলেছেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব নাগরিক করোনামুক্ত সনদ নিয়ে ইতালি, জাপান প্রভৃতি দেশে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। ইতালি এ রকম ১৬৫ জন যাত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। তারা আগামী তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের যাত্রীদের ইতালিতে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশে একই ঘটনা ধরা পড়ার পর তারা বাংলাদেশি যাত্রীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

ইতালির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিক ও বাংলাদেশ থেকে আসা নাগরিকেরা আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইতালিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় কোনো এয়ারলাইনস বাংলাদেশ থেকে কোনো যাত্রী আনতে পারবে না। এমনকি কোনো ট্রানজিট ফ্লাইটেও যাত্রী আনা যাবে না, যাঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। কোভিড–১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ নিয়ে দেশের মানুষ যখন বিদেশে যাচ্ছেন, সেখানে তঁাদের পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত করা হচ্ছে। দেশের পরীক্ষাকে বিভিন্ন দেশ আর গ্রহণ করছে না।

করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে এর আগে জেকেজি হেলথ কেয়ার নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি ধরা পড়ে। ওই প্রতিষ্ঠানও নমুনা পরীক্ষা না করে প্রত্যেক সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফুল চৌধুরীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। রিজেন্ট হাসপাতালের মতো সব নিয়মকানুন উপেক্ষা করে তাদেরও করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কেন তারা খুঁজে খুঁজে ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়? এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের কাছ থেকে কেবল কোটি কেটি টাকা হাতিয়ে নেয়নি, তাদের ঠেলে দিয়েছে ভয়াবহ বিপদের মধ্যে। এর জন্য কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক—কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না?

র‍্যাব রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রতারকদের ধরেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ছত্রচ্ছায়ায় আরও কোনো প্রতারক চক্র দেশ ও মানুষের সর্বনাশ করেছে কি না কে জানে। এখন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে কৈফিয়ত চেয়েছে কেন তারা অননুমোদিত হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করল? এর আগে মন্ত্রণালয় কি ঘুমিয়ে ছিল?

গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সম্রাটসহ যাঁরা ধরা পড়েছিলেন, তঁাদের প্রায় সবাই ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখন কোভিড–১৯ পরীক্ষা কেলেঙ্কারির হোতাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন বলছেন, সাহেদ তাঁদের কেউ নয়। কিন্তু তথ্যপ্রমাণ বলছে, তিনি একবার দলের আন্তর্জাতিক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। এরপর কমিটিতে না থাকলেও তিনি দলের ও নেতাদের নাম ভাঙিয়ে নানা রকম অপকর্ম করেছেন। এমন কোনো ভিআইপি, ভিভিআইপি নেই, যাঁর সঙ্গে তাঁর ছবি নেই। তিনি ভিআইপিদের সঙ্গে তোলা ছবি ও টিভি টক শো ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন দেশজুড়ে। সাহেদ-শহিদ দুজনই টর্চার সেল গঠন করেছিলেন। একজন দেশে। আরেকজন বিদেশে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। কিন্তু তিনি কি এমন একটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর দেখাতে পারবেন, যেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি নেই? এ রকম বিচ্ছিন্ন একটি–দুটি অভিযানে রোগ সারবে না। এ কথা আমরা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময়ও বলেছিলাম। এখনো বলছি। দুর্নীতি নামের যে বিষবৃক্ষটি রোপিত হয়েছে, তার শিকড় না কেটে কেবল ডালপালা কাটলে কোনো কাজ হবে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]