ফরসা ত্বকের বাণিজ্য ও বর্ণবাদ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি জর্জ ফ্লয়েড শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে বর্বরোচিতভাবে নিহত হলে এই হত্যার প্রতিবাদে জাতিগত সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামে বেগবান হয়ে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এবং এর সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্ণ ও জাতিগত অসমতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে প্রধান প্রধান ভোগ্যপণ্য প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পানি এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানালে তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে সমালোচনার ঢেউ ওঠে। কারণ, তারা সৌন্দর্যের এমন একটি মানের প্রবক্তা ও প্রচারকারী, যার মূল বর্ণবাদ ও বৈষম্যের মধ্যেই প্রোথিত। এদের মধ্যে ইউনিলিভার, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, লরিয়াল ও জনসন অ্যান্ড জনসন এই পক্ষপাতদুষ্ট মানের বৃহত্তম প্রবক্তা, যারা এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ভোগ্যপণ্য বিপণন করে থাকে ত্বকের ফরসা ও সাদা বর্ণের স্তুতি ও মহিমা বিজ্ঞাপিত করে। এসব দেশের বাজারের জন্য উৎপাদিত ত্বকের রং ফরসাকারী পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিপণন করা হয় না। এদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হচ্ছে এরা ফেয়ারনেস পণ্যের বাণিজ্য ও প্রচারণার মাধ্যমে কালারিজম, অর্থাৎ ফরসা ত্বকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বদ্ধমূল রাখে।

দীর্ঘদিন ধরেই বড় বড় মার্কিন ও ব্রিটিশ বহুজাতিক প্রসাধন কোম্পানির বিরুদ্ধে বিশ্ববাজারে ফেয়ারনেস পণ্য বিপণনে প্রকাশ্যে বর্ণবাদী বিজ্ঞাপন প্রচার করার অভিযোগ ছিল। নিকট অতীতেও ‘সাদাই সুন্দর’, ‘সাদাই বিশুদ্ধ’র মতো (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্টত্ববাদীরা এই মত পোষণ করে) বর্ণবাদী বার্তা প্রচার করে ফেয়ারনেস পণ্য বিজ্ঞাপিত হতো। বিভিন্ন সময়ে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন এতটা উগ্রভাবে না হলেও এখনো তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে সুকৌশলে গৌর বর্ণকে প্রাধান্য দিয়ে উল্লেখিত অঞ্চলগুলোয় ফেয়ারনেস পণ্যের প্রচার ও বিপণন করা হয়। বাস্তবে এসব কোম্পানি অবিশ্বাস্য মুনাফা করে ‘ফরসাই সুন্দর’—কেবল এই বার্তা সুকৌশলে নানাভাবে প্রচার করে।

পরিবর্তিত এই সময়ে ফেয়ারনেস পণ্যের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর পক্ষে নিশ্চুপ থাকা কঠিন হয় এবং এই প্রথম দেখা গেল তারা কিছু নতুন পদক্ষেপ নেয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পণ্য প্রত্যাহার এবং উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করে দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের নাম ও বিজ্ঞাপনী প্রচারণা থেকে ফেয়ারনেস, হোয়াটেনিং, লাইটেনিং এই শব্দগুলো বাদ দেয়। বিভিন্ন ব্রান্ডের জনপ্রিয় ফেয়ারনেস পণ্যসামগ্রী মূলত এশিয়া, আফ্রিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের বাজারের জন্য উৎপাদন ও বিপণন করা হয়।

ফেয়ারনেস পণ্য উৎপাদনের সূত্রপাতই হয়েছে সমাজে আগে থেকে বিদ্যমান কালারিজমকে ব্যবসায়িক স্বার্থে কাজে লাগিয়ে। এই পণ্যের বাণিজ্য সমাজে কালারিজমের আরও বিস্তার ঘটায়, বদ্ধমূল করে এবং ফরসা রংকেই সৌন্দর্যের সমার্থক করে নারীকে তার গায়ের রং নিয়ে অনিরাপদ ও অপর্যাপ্ত করে তোলে। বিদ্যমান বৈষম্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিবেশে কেবল গায়ের রংই মানুষের সৌন্দর্য ও মূল্য নির্ধারণ করে, এমন বর্ণবাদী ধারণার প্রচার অতি স্বাভাবিকভাবে গৃহীত ও অনুমোদিত হয়, এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহাসিক কার্যকারণ।

শত বছর ধরে শ্বেতকায় ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠ এবং নিজেদের জাতি, সমাজ, সংস্কৃতিকে অধস্তন হিসাবে দেখতে বাধ্য হওয়ায় অনেক মানুষই পরিণামে এটাই বিশ্বাস করতে থাকেন এবং সেই দ্বিবিভাজন অনুযায়ী আচরণ করেন। যার ফলে কালারিজম এমনই একটি ধারণা বা বিশ্বাসের প্রতিফলন হয়ে টিকে থাকে যে শ্বেতকায় না হলেও এর কাছাকাছি হলেও তা মানুষের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের যেসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইউরোপীয় উপনিবেশ ছিল সেখানেই কালারিজম শিকড় গেড়ে আছে।

ভারতীয় উপমহাদেশেও কালারিজম একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনমনে প্রবিষ্ট হয়। প্রাচীন ভারতে গায়ের বর্ণভিত্তিক সামাজিক বিভাজনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। এই বিষয়ে গবেষকেরা অনেকটা একমত যে প্রাচীন ঐতিহ্য নয়, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়েই কালারিজম প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগেই ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ঘটে, সুদীর্ঘকালের মুসলিম শাসনামলেও পারস্য, তুর্কি, আরবীয় বংশোদ্ভূত শাসকেরা উপমহাদেশের সাধারণ জনগণের থেকে আলাদা হালকা বর্ণের ছিলেন। এরপর শ্বেতকায় ব্রিটিশ শাসনকাল হওয়ায় শত শত বছর ধরে সব শাসকই গায়ের বর্ণে সাধারণ জনগণ থেকে আলাদা হওয়ায় এই ধারণা প্রতিপাদিত হয় যে গৌর বর্ণ ক্ষমতা, শক্তি ও উচ্চতর মর্যাদার প্রতীক।

তবে মুসলিম বা মোগল আমলে গায়ের বর্ণভিত্তিক বিভাজনের কোনো আদর্শ বা রীতি অনুসৃত হয়নি। মূলত, ব্রিটিশ শাসকেরাই ঔপনিবেশিক শাসনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় শ্রেষ্ঠ শ্বেতকায় ও অনুত্তম কৃষ্ণকায় এই দ্বিবিভাজন নীতি প্রতিপাদন করেন। নিজেদের শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান জাতি ও প্রভুশ্রেণি হিসেবে প্রচার করে, অনুত্তম, অধস্তন অশ্বেতকায় জাতিকে শাসন করার বর্ণবাদী যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করেন। শাসনকাজে সহায়তার জন্য কিছুটা উচ্চ পদে তাঁরা হালকা বর্ণের দেশীয় মানুষদেরই প্রাধান্য দেন আর নিম্নবর্গের কাজে কৃষ্ণকায় মানুষদের নিযুক্ত করে অধস্তন করে রাখেন। এভাবেই গৌর বর্ণ তখনকার সময় উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হয়।

ভারতে হালকা বা ফরসা ত্বক আভিজাত্য, উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণির পরিচায়ক বলে ভাবা হয়। গায়ের রং যত শ্যামলা বা কালো হয়—বিশেষ করে নারীদের বেলায়—বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম তত বেশি। ভ্যাসলিন হেলথি হোয়াইট একটি সার্ভের ফলাফলে দেখিয়েছে, ১০ জনের মধ্যে ৮ জন ভারতীয় নারী বিশ্বাস করেন, ফরসা রং সমাজে নারীদের বাড়তি সুবিধা দেয়। কালারিজমের সঙ্গে আর্থসামাজিক অবস্থা, লিঙ্গ, শ্রেণি ও বর্ণগত অবস্থান মিলেমিশে সমাজে বৈষম্যের প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে।

বাংলাদেশে কালারিজম আছে কি না বা এই সমস্যার গভীরতা কতটা, তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা বা একাডেমিক গবেষণা হয় না বললেই চলে। তবে মানুষের সামাজিক আচার-আচরণে এটা স্পষ্ট যে আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত কালারিজম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব ও আচরণের অন্যতম উৎস। ভারতের মতো আমাদের দেশেও ব্যক্তির, বিশেষ করে নারীর সৌন্দর্য নিরূপণের প্রধানতম প্রচলিত নির্ণায়ক ও মানদণ্ড হচ্ছে ফরসা ত্বক। যদিও আর্থসামাজিক অবস্থানভেদে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছুটা তারতম্য আছে, তারপরও নারীদের বৃহদাংশই বিশেষ করে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শ্যামা বা কালো মেয়েরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের রং নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, বেড়ে ওঠার সময় নিজ পরিবার, আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁটা ও নিগ্রহের শিকার হয়, তাদের অনবরত মনে করিয়ে দেওয়া হয় সমাজের প্রচলিত মান অনুযায়ী তারা অসুন্দর। বাল্যকাল থেকেই তাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করা হয় যে গায়ের রঙের কারণে বিয়ের জন্য তারা আকাঙ্ক্ষিত নয়, বিয়ের বাজারে তাদের মূল্য কম, তাই তাদের ওপর সমাজ আরোপিত দণ্ড বা জরিমানা বেশি হয়। এসব কারণে প্রচলিত মানদণ্ডে তথাকথিত অসুন্দর মেয়েদের ভেতর হীনম্মন্যতা, দুঃখবোধ ও সমাজ বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের মতো পুরুষদের ক্ষেত্রে গায়ের বর্ণ নির্যাতনের অনুষঙ্গ হয় না। তবে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এক গবেষণামূলক জরিপে দেখা গেছে, ৩০০ নারী-পুরুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই ফরসা জীবনসঙ্গী কামনা করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফরসা বংশধরের আশায় অভিভাবকেরাও ফরসা মেয়েদেরই প্রাধান্য দেন। এরূপ মনোভাবের কারণে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একটি মেয়ের ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা ও অন্তর্গত সৌন্দর্যের চেয়ে তার গায়ের বর্ণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ভয়ংকর মনোভাব উভয় দেশের সমাজে এতটাই বদ্ধমূল হয়ে আছে যে এটা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। কার্যত, সমাজে নারীর অধস্তনতা ও নির্যাতনের পেছনে সক্রিয় অন্য উপাদানগুলোকে কালারিজম আরও শক্তিশালী করে, অন্যান্য চলকের সঙ্গে মিশে যায় বলে আলাদা করে বিষয়টি প্রাধান্য কম পায়।

ফেয়ারনেস পণ্য ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ক্ষতির বিষয়টিও উপেক্ষা করার উপায় নেই। অধিকাংশ ফেয়ারনেস পণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান যেমন অতি মাত্রায় সিসা, স্টেরয়েড, কর্টিকোস্টেরয়েড, হাইড্রোকুইনোন ও পারদ ব্যবহার করা হয়। এসব পণ্য দীর্ঘদিন ধরে ত্বকে নিয়মিত ব্যবহারের ফলে স্নায়বিক ও কিডনির জটিলতা, একজিমা, বেক্টেরিয়াল ও ফাংগাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ফেয়ারনেস পণ্যে অজৈব পারদের উপস্থিতি কিডনির ক্ষতি করে, ত্বকের ক্যানসার, রঙের বিবর্ণতা, ব্যাকটেরিয়াল ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনের বিরুদ্ধে ত্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

দীর্ঘ সময় ধরে ত্বক ফরসাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে কেবল ফরসা ত্বক থাকাকেই সৌন্দর্যের সমার্থক এবং নারীর সাফল্য, আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস অর্জনের পূর্বশর্ত বলে যে প্রচারণা চলেছে,তা আত্মস্থ করে অন্তত তিন প্রজন্মের এক বিশাল এবং অনুগত ভোক্তা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা হয়তো আরও কয়েক প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে যদি না কালারিজম সমাজ থেকে দূর হয়।

ড. হাফিজা বেগম: সাবেক শিক্ষক, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।