মহামারি ও বন্যা

চলমান করোনা মহামারি আরও কত দীর্ঘস্থায়ী হবে, এ দুশ্চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একটি দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আশঙ্কা। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া বন্যায় দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৫ জেলা প্লাবিত হয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দিয়েছে আরও ব্যাপক এলাকাজুড়ে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অন্তত ২৩টি জেলা বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে বলে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র সতর্ক করেছে। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিচু অংশগুলোতে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবনে কঠিন দুর্ভোগ নেমে আসছে। ইতিমধ্যে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। সামনের দিনগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বাড়ার আশঙ্কাই বেশি।

এবারের বন্যার বাড়তি সমস্যা হলো আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বন্যার ধরন ১৯৯৮ সালের বন্যার মতো দীর্ঘস্থায়ী। সেই বন্যা ৩৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল, দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকায় জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। এবারের বন্যাও যদি সে রকম দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তা মোকাবিলার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ও উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। বিশেষ সমস্যা হলো বন্যা যখন এসেছে, তখন সারা দেশে কোভিড–১৯ মহামারি চলছে। এ পরিস্থিতিতে বন্যার্তদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন।

এক. যাঁদের ঘরবাড়ি জলমগ্ন হয়েছে, তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হবে। হাজার হাজার পরিবার ইতিমধ্যে উঁচু বাঁধে খোলা আকাশের নিচে জড়ো হয়েছে। তাঁদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানি প্রথম চাহিদা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ এখন পর্যন্ত যৎসামান্য: মাত্র ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ও ১০ হাজার ৭০০ টন চাল। বরাদ্দ আরও অনেক গুণ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, খাবারের বদলে নগদ টাকা বিতরণ করা উচিত, যাতে বন্যার্তরা নিজেরাই খাবার কিনতে পারেন। এতে চাল বিতরণের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব হবে।

দুই. আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নৌকা ও অন্যান্য যানবাহনের খরচ বন্যার্তদের পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে, প্রয়োজনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তা নিতে হবে। তিন. বিশুদ্ধ পানির জন্য বাঁধ ও অন্যান্য আশ্রয়স্থলে টিউবওয়েল বসাতে হবে। চার. কোভিড–১৯ সংক্রমণ এড়ানোর জন্য হাত ধোয়ার সাবান ও গামছা (মাস্কের কাজও করবে) সরবরাহ করতে হবে। পাঁচ. বন্যার্তদের গবাদিপশু রক্ষা করতে হবে। উত্তরাঞ্চলে কিছু গরুর মধ্যে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে, যা অতি সংক্রামক। তাই চর্মরোগে আক্রান্ত গবাদিপশুগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে রাখা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, গোখাদ্য সরবরাহ করতে হবে। বন্যার্তদের আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হওয়া ঠেকাতে তাঁদের প্রাণিসম্পদ রক্ষার উদ্যোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এবারের দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিশেষ অসুবিধা হলো যঁাদের ঘরবাড়ি বসবাসের উপযোগী নেই, তঁাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গাগুলো সীমিত। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় যেসব আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশই বেসরকারি জমিতে। ফলে সেগুলো পরবর্তী সময়ে আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি, বেদখল হয়ে গেছে। সেগুলো অবিলম্বে পুনরুদ্ধার করে বন্যার্তদের অন্তত আগামী তিন সপ্তাহ আশ্রয় গ্রহণের উপযোগী করা প্রয়োজন। আর মনে রাখা প্রয়োজন, বন্যার্তদের কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে একবার কোভিড–১৯ সংক্রমণ শুরু হলে তা অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার প্রকট আশঙ্কা থাকবে। সুতরাং স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষসহ বন্যা মোকাবিলায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের এ বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

বন্যা চলাকালে বিপুলসংখ্যক দুর্গত মানুষকে ক্ষুধা, কোভিড–১৯সহ অন্যান্য রোগব্যাধি থকে রক্ষা করাই প্রধান কর্তব্য। এ জন্য প্রথমত বরাদ্দ অনেক বাড়ানো এবং তার সুষ্ঠু বিতরণসহ সামগ্রিক সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি প্রশাসন, স্থানীয় সরকার কাঠামো, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা—সবার সম্মিলিত তৎপরতায় এ গুরুতর সংকট মোকাবিলা করতে হবে।