এক সাহেদ আলোচনায়, বাকিরা কোথায়?

মো. সাহেদ বা সাহেদ করিম।
মো. সাহেদ বা সাহেদ করিম।

বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। ভুয়া করোনার সনদ দিয়ে শত শত কোটি টাকা পকেটে ভরেছে জেকেজি। রিজেন্ট হাসপাতাল অনুমোদন ছাড়াই দিব্যি চার বছর সবার নাকের ডগায় বসে হাসপাতাল ব্যবসা চালিয়ে গেল। কেউ কোনো কিছু টেরই পেল না? সবাই দেখেও না দেখার ভান করেছে? আলোচনায় এখন নতুন নাম—সাহেদ করিম। ক্যাসিনো–সম্রাট আর পাপিয়া–পর্ব যেন শেষ। এখন সাহেদ–পর্বের শুরু। সাহেদ করিম একধারে ব্যবসায়ী, টক শোর আলোচক; রাজনীতিবিদও বটে। তিনি এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। সমাজের গণ্যমান্য সব লোকের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন ছবি দেখে তা–ই মনে হবে। মনে হবে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যমকর্মী—সবার সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য।

এহেন বিশিষ্ট ভদ্রলোকের নানা কীর্তিকলাপ এখন সবার মুখে মুখে। তাঁর যেসব কর্মকাণ্ড বের হয়ে আসছে, তাতে মাফিয়াদের চরিত্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সারা বিশ্বে বড় বড় মাফিয়াকে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। এই মাফিয়ারা নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সিনেমা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা—সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সবাই সঙ্গেই তাদের মধুর সম্পর্ক থাকে। কেবল হিসাবে গরমিল হলেই তারা ধরা পড়ে বা এদের ধরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সাহেদের যেসব তথ্য–উপাত্ত এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে এর আগে প্রতারণার মামলা হয়েছে, তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু এড়িয়ে এবং থোড়াই কেয়ার করে সাহেদ রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছিলেন। সমাজের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই, যাঁর সঙ্গে সাহেদের ছবি নেই। শুধু আমাদের দেশই না; পাশের দেশ ভারতের অন্দর মহলে ঢুকে গিয়েছিলেন সাহেদ। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বা বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও তাঁর ছবির দেখা মিলছে।

এই রকম প্রভাবশালী লোকের নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য থাকাই স্বাভাবিক। সাহেদ করিমেও ছিল। যার মধ্যে হাসপাতাল ব্যবসা অন্যতম। রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার চিকিৎসাসেবা শুরু করে আলোচনায় আসেন তিনি। দেখা যাচ্ছে, তিনি স্বাস্থ্য খাতে যতটা সেবা দিয়েছেন, তার থেকে লোপাট করেছেন বেশি। এমনিতেই দেশের সেবা খাতগুলো একেবারেই ভেঙে পড়েছে; পরিবহন বা গণযোগাযোগ খাত বলেন, অথবা স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও নাগরিক পরিষেবার খাতগুলোর অবস্থা খুবই করুন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বৈশাখ মাসে হাঁটুজলের কথা বলা আছে। আর আমাদের শহর–বন্দরে আধঘণ্টা বৃষ্টি হলেই হাঁটুজল জমে। যা–ই হোক, বড় বড় উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পরিস্থিতি মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। কিন্তু করোনার দুর্যোগ স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশাকে সবার সামনে উন্মুক্ত করেছে।

এমন না যে এই প্রথম স্বাস্থ্য খাতের কোনো সিন্ডিকেট বা মাফিয়ার তথ্য গোচরীভূত হলো; অতীতের সব সরকারের সময়ই মাফিয়া সিন্ডিকেটগুলো সক্রিয় ছিল। এবার যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে। মাফিয়াদের কাছে মন্ত্রী–সচিবেরা হয় অসহায় অথবা তাঁদের যোগসাজশ আছে। সাহেদকাণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আফম রুহুল হক এক বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে বলেছেন, তিনি সাহেদসহ বিভিন্ন মাফিয়ার নাম প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি; বরং এসব মাফিয়ার দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েছেই।

এদের দৌরাত্ম্যের কারণে স্বাস্থ্য একেবারেই ফাঁপা খাতে পরিণত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা এখন পুরোপুরি বেসরকারি খাতনির্ভর। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ বরাবরই আছে। এই সময় রীতিমতো হাহাকার চলছে। আক্রান্ত রাজনীতিবিদেরা কমই সরকারি হাসপাতালে গেছেন। হয় সামরিক হাসপাতালে গিয়েছেন নতুবা বেসরকারি হাসপাতালে নতুবা বিদেশে। নিজেদের তৈরি হাসপাতালের ওপর নিজেদেরই ভরসা নেই। অথচ বছর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়। নতুন নতুন হাসপাতাল স্থাপন বা যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব অর্থের পুরোটাই বিভিন্নভাবে সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকে যায়।

সম্প্রতি এক প্রবণতা শুরু হয়েছে। এটা হচ্ছে পণ্যের অতিরিক্ত মূল্য দেখানো। ১০ টাকার জিনিসকে ১০০০ টাকা মূল্য দেখানো হচ্ছে এবং এটা এখন প্রকাশ্যেই বলেকয়ে করা হচ্ছে। অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের পণ্য কিনছে সরকার। করোনা প্রতিরোধে পিপিই ও মাস্ক সরবরাহেও মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অভিযোগ ছিল, সাধারণ মাস্ক ভরে দেওয়া হয়েছিল এন৯৫ মাস্কের কার্টনে। এ নিয়ে অভিযোগ করায় চিকিৎসকদের বদলিসহ নানা ধরনের হয়রানি করা হয়েছে। কিন্তু নিম্নমানের মাস্ক বা পিপিই সরবরাহ করার দায়ে কাউকে সাজা দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

এসব সরবরাহকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই–বা নেওয়া যাবে কীভাবে। কারণ, এখান স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণ করেন সাহেদ বা জেকেজির ডা. সাবরিনার মতো প্রভাবশালীরা। এক অদৃশ্য শক্তির জাদুবলে তাঁরা ফুলেফেঁপে ওঠেন। জেকেজি ও রিজেন্ট ভুয়া সনদ দিয়ে রমরমা ব্যবসা করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই এসবের অনুমতি মেলে। কোনো কারণে হয়তো শাহেদের খবর বেরিয়েছে। এ রকম অনেক সাহেদ এখনো ক্ষমতার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাহেদ, পাপিয়া, শামিম, সম্রাটরা একে অপরের কীর্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

একটি দেশের সার্বিক নৈতিকতার মান কতটা নিচে নেমে গেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়া রিজেন্ট ও জিকেজি ভুয়া করোনার সনদ বিক্রি করে? অভিযোগ তো চীনকে নিয়েও আছে। বলা হয় দেশটি সংখ্যা গোপন করেছে। কিন্তু চীন কাউকে ভুয়া সনদ দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছে বলে শোনা যায়নি। গোলমালটা বেধেছে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশি যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায়। অনেক দেশেই প্রবেশ করতে হলে এখন করোনা নেগেটিভ সনদের প্রয়োজন হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের বড় একটি অংশই এই সময়ে দেশে অবস্থান করেন। তাঁদের ফেরত পাঠাতে গিয়েই যত বিপত্তি। দেখা গেছে, নেগেটিভ সনদ নিয়ে যাওয়া অনেকে করোনায় আক্রান্ত। ভুয়া সনদ দেওয়া হলে এমন হওয়াই স্বাভাবিক।

সাহেদকাণ্ড, পাপিয়ার কীর্তি, ক্যাসিনোর আসরসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, এক জমজমাট অ্যাকশন সিনেমার দর্শক হয়ে বসে আছি আমরা। এ শুক্রবারেও কুমিল্লায় জুমার নামাজের পর এক কাউন্সিলরের নেতৃত্বে এক ব্যক্তিকে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে মারা হয়েছে। এই সিনেমাতে কী নেই? রাজনৈতিক কমেডিও আছে। ঘটনা জানাজানির পর এখন বলা হচ্ছে সাহেদ আওয়ামী লীগের কেউ না—হাওয়া ভবনের লোক। বিএনপির ঘনিষ্ঠ। কী ভয়ংকর কথাবার্তা। হাওয়া ভবনের লোক আওয়ামী লীগের অন্দর মহলে ঢুকে গেল কী করে, তার উত্তর কেউ দিচ্ছে না। এই অ্যাকশন, ড্রামা, সাসপেন্স, মধুকুঞ্জ, ক্যাসিনো বার, প্রকাশ্যে গোলাগুলি দৃশ্য সিনেমাতেই ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে এসব কারওই ভালো লাগার কথা না। মানুষের মনে প্রশ্ন, জনগণের টাকা লোপাট করার সুযোগ সাহেদ, সাবরিনাদের কে করে দিল? এই প্রশ্নের সমাধান না মিললে সাহেদদের দৌরাত্ম্য সমাজ থেকে যাবে না। একজন যাবে, আরেকজন চলে আসবে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক