সব জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করুন

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করে বিশেষজ্ঞরা বলে চলেছেন, সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য দৈনিক শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা ন্যূনতম ২০ হাজারে উন্নীত করা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার ধরেছে উল্টো পথ। এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চসংখ্যক (১৮ হাজার ৪৯৮টি) পরীক্ষা করা হয়েছিল গত ২৬ জুন। আর ১২ জুলাই দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেল, আগের ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা হয়েছে ১১ হাজার ৫৯টি। সংক্রমণের প্রবণতা যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন পরীক্ষার সংখ্যা নিম্নমুখী করার কৌশল নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ।

৭ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ‘করোনা শনাক্তের পরীক্ষায় নিয়ন্ত্রণ’ শিরোনামে এক বিশদ প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছে, কী কী কৌশলে শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। প্রথমত, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট—এই চার উপসর্গ না থাকলে কোনো ব্যক্তির পরীক্ষার জন্য নমুনা গ্রহণ করা হবে না। এটি একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ, করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশের কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না; কিন্তু উপসর্গহীন করোনাবাহী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে গেলে যেকোনো সুস্থ মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন। বস্তুত এভাবেই আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, কিন্তু পরীক্ষা করা হয়নি বলে তাঁরা শনাক্ত রোগীদের হিসাবের বাইরে থেকে গেছেন। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণের প্রকৃত পরিস্থিতি ধারণাতীত মাত্রায় অস্বচ্ছ রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ‘নিয়ন্ত্রণ’ আরোপ করে প্রকৃত ‘সংক্রমণ পরিস্থিতি লুকানোর চেষ্টা সবার জন্যই বিপদ ডেকে আনবে’।

পরীক্ষায় ফি আরোপ করার সিদ্ধান্তের পেছনে লোকজনকে পরীক্ষা করাতে নিরুৎসাহিত করা ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা লোকজনের পরীক্ষার সুযোগ হরণ করা হয়েছে। পরীক্ষা কিটের স্বল্পতা দূর করার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি এবং করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথগুলোতে দৈনিক সংগ্রহের সংখ্যা কমিয়ে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। আর নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র খোলার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ বেসরকারি উদ্যোগের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। গত এক মাসে যে ১৮টি নতুন পরীক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৫টিই বেসরকারি। আরও বড় সমস্যা হলো ঢাকার বাইরে পরীক্ষাকেন্দ্র খোলার বিষয়টি অবহেলা করা হচ্ছে। এখনো দেশের ৪২টি জেলায় কোনো পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়নি। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে পত্রপত্রিকায় খবর বেরোচ্ছে, ঢাকার বাইরে দ্রুতগতিতে সংক্রমণ বেড়ে চলেছে।

করোনা মহামারি শুরুর সময় থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শনাক্তকরণ পরীক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছে এবং বারবার বলেছে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের এ পরামর্শকে গুরুত্বসহকারে নেয়নি। তাই তো বিশ্বের সবচেয়ে কম পরীক্ষার দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের স্থান। জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার সংখ্যার দিকে বিশ্বের ২১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১৪৬ নম্বরে।

পরীক্ষার সংখ্যা যখন বাড়ানো দরকার, তখন তা কমিয়ে আনার কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে সরকার করোনা রোগী শনাক্ত করার পেছনে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। পাঁচজনের নমুনা পরীক্ষা করে একজন রোগী শনাক্ত হচ্ছে, এতে সরকারের খরচ পড়ছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। সরকার এটাকে বেশি ব্যয় মনে করছে।

কিন্তু আমাদের মনে হয়, খরচ বাঁচানোর এ কৌশল বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ভুল কৌশল থেকে সরে এসে অবিলম্বে দেশের ৪২টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করে এবং নমুনা সংগ্রহ ও কিটের সংখ্যা বাড়িয়ে এবং পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়ে দৈনিক অন্তত ২০ হাজারে উন্নীত করা হোক।