পাটের বেদন ও তৈলাক্ত লাঠি বাওয়ার ইতিহাস

বাংলাদেশের পাট ও পাটকলের ইতিহাস বানরের তৈলাক্ত লাঠি বেয়ে ওঠার মতো। যখনই এই খাত সফল হতে গেছে, তখনই এর মাথায় বাড়ি পড়েছে। পাকিস্তান আমলে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ছিল পাটকলগুলো। পাট রপ্তানির টাকা দিয়ে ইসলামাবাদ-করাচি গড়ে উঠলেও ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’—এই দাবি তুলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। পাট রপ্তানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়াই ছিল আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রমাণ। বলা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে পাটেরও অবদান ছিল।

বাঙালি মুসলমানের বিকাশের পেছনেও ছিল পাটের দাইমার ভূমিকা। উনিশ শতকের শেষাশেষি জমিদারি আইনে কিছু সংস্কার হলে বাংলায় পাটের উৎপাদন বাড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব বাজারে পাটের চাহিদা বেড়ে যায়। পাটের বরকতে গ্রামের কৃষক-জোতদার, পাটের আড়তদারের সন্তানেরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পাস দিতে থাকে। গ্রামীণ কৃষকের ভদ্রলোক হয়ে ওঠার ইতিহাস তাই পাটেরও ইতিহাস। পাট চাষ, বেচা-বিক্রি এবং রপ্তানিতে অর্জিত টাকা গ্রাম-মফস্বলের সম্পদ বাড়ায়, বাড়ায় শহরায়ণ।

যে পাটের বঞ্চনার কথা বলে ছয় দফা জয়যুক্ত হলো, তার প্রতিদান দেওয়া হলো স্বাধীনতার পর। জাতীয়করণের নামে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া পাটকলগুলোকে নেতা ও আমলাদের লুটপাটের আখড়া বানানো হলো। অথচ কথা ছিল, স্বাধীন দেশে বাঙালিদের দায়িত্বে ও কর্তৃত্বে পাটশিল্পের জয়জয়কার ঘটবে। কিন্তু দুর্নীতির ঘুণপোকারা সেটা খেয়ে ফেললে নতুন সমাধান হলো বেসরকারীকরণ। বেসরকারীকরণ হয়ে দাঁড়াল সরকারি সম্পদ সরকারের ঘনিষ্ঠদের হাতে তুলে দেওয়ার শর্টকাট পথ। ১৯৮২ সালে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি মেনে এরশাদ শিল্পনীতি ঘোষণা করলেন। সরকারি মালিকানাধীন ৬৫০টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ছাড়া হয়। এটাই ছিল সে-যাবৎকালে বিশ্বের সব থেকে বড় বেসরকারীকরণ। ৬২টি পাটকলের মধ্যে ৩৩টি বিক্রি করা হয় এমন লোকদের কাছে, যাঁদের শিল্প চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। স্বাধীনতার পরের দুটি সরকারের আমলে পাট-বস্ত্র ও চিনিশিল্প রুগ্‌ণ হয়ে পড়ে এবং এরশাদ আমলে সেসবের পূর্ণ বারোটা বাজে। বিশ্বের আর কোথাও একটি দেশের শিল্প-অর্থনীতিকে এত দ্রুত কাবু করার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীকেও বন্ধ করে দেয়।

বানরের তৈলাক্ত লাঠি বেয়ে ওঠা আর পড়ার গল্পটা এখানেই প্রাসঙ্গিক। ১৯৭২ সালের ‘জাতীয়করণ’, ১৯৮২ সালের ‘বেসরকারীকরণ’ আর ২০০২ সালে আদমজীর ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’; যে নামেই ডাকি সবই ছিল পাটের সর্বনাশের একেকটি অধ্যায়। ২০২০ সালে এসে আবার চলছে ২৬টি সরকারি পাটকল বন্ধের আয়োজন।

রাষ্ট্রায়ত্ত হলে পাটকলের ভালো হবে, বিষয় সেটা নয়। বিষয় হলো, রাষ্ট্রায়ত্তই হোক আর বেসরকারীকরণই হোক, দুর্নীতি থাকলে লোকসানই নিয়তি। এত এত আয়োজন, কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু নেই। যখন পাটের দাম কম, তখন বিজেএমসি পাট কেনার টাকা দেবে না। সেই টাকা যখন ছাড় হবে, তখন পাট আড়তদারের গুদামে। এমনও হয়েছে, আড়তদারের পাট সরকারি গুদামে রাখা হয়েছে। সরকারি গুদামে রাখা আড়তদারের পাট পরে চড়া মূল্যে পরিবহন খরচসহ সরকারি পাটকল কিনেছে। লাভের গুড় এভাবেই পিঁপড়ারা খেয়ে গেছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায়, তখন তাদের শ্রমিক দলের নেতারা দুর্নীতির বখরা লুটেছেন। বিজেএমসি, কারখানার প্রশাসন ও সরকারি নেতাদের এই দুর্নীতির ত্রিশূল সোনার হাঁসটিকে মারলেও দায়মুক্তি ভোগ করে আসছে। কিন্তু ছাঁটাইয়ের শাস্তি পাচ্ছেন নিরীহ শ্রমিক। এক হিসাব বলছে, ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করে পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন সম্ভব ছিল। সেই পথ না ধরে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের তহবিলে রাখা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা!

তৈলাক্ত লাঠির তলার জায়গাটা হলো পাট চাষ, আর ওপরের ডগা হলো পাটশিল্প। ব্রিটিশ আমলে বাংলার পাট দিয়ে কলকাতার পাটকল চলত। আমাদের দায়িত্ব ছিল কেবল পাট ফলিয়ে যাওয়া আর সস্তায় তা পাঠানো। দেশভাগে সেসব পাটকলের কিছুই পূর্ববাংলার ভাগে পড়েনি, হাতে রইল কেবল পাটখেত। পাকিস্তান আমলে পাটকল গড়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু তার সুফল পেল পশ্চিম পাকিস্তান। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার আমরা হচ্ছি দেশের বাইরের পাটকলের কাঁচামালের জোগানদাতা।

বলা হচ্ছে পাট খাতে রিফর্ম বা সংস্কার হবে। এ কেমন রিফর্ম, যেখানে পাট খাত শিল্প হয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যায় অন্য দেশের পাটকলে কাঁচামাল জোগানদাতার ভূমিকায়!

এটা ঠিক, ব্যক্তি খাতে দেওয়া পাটকলগুলোর কিছু কিছু লাভ করছে—অন্যগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এই ব্যক্তি খাতে শ্রমিকদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা পেয়েছে? সরকারি পাটকলগুলো একসময় লাভও দিয়েছে, শ্রমিকের জীবনমানও উন্নত করেছে। লোকসান মাপার সময় এই হিসাব মাথায় রাখা দরকার। নিছক অর্থনীতিবাদী হিসেবে এটা ধরা পড়ে না। মানুষ কৃষি থেকে শ্রমে এসেছিল শোভন ও নিরাপদ জীবনের জন্য। আমরা উৎপাদন করছি কেন? করছি, যাতে সমাজ উপকৃত হয়। মুনাফা সরকার বা মালিক নিক, কিন্তু পাটকলগুলো বন্ধ করা থেকে সমাজ কী পাবে, তা পরিষ্কার করা হোক।

একসময় পাট ছিল একমাত্র রপ্তানিযোগ্য খাত, তারপর গার্মেন্টস এসেছে, চামড়া এসেছে। পাটকল যাচ্ছে, চামড়াশিল্প যাচ্ছে, রইল কেবল পাটখেত আর গতরখাটা দেহ। একক খাতনির্ভর অর্থনীতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পাটজাত শিল্প, চামড়াজাত শিল্প আর পোশাকশিল্প কি একসঙ্গে বিকশিত হতে পারে না? যখন পাটশিল্পের দ্বিতীয় খাত হিসেবে দাঁড়ানোর কথা, তখনই কিনা এর ওপর আঘাত নেমে এল?

ফারুক ওয়াসিফ: কবি ও লেখক। প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]