দুবাইয়ে নারী পাচার

গত জুন মাসে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে মানব পাচার রোধে বাংলাদেশের এক ধাপ উন্নতির খবরটি ছিল আশাব্যঞ্জক। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ মানব পাচার নির্মূলের ন্যূনতম মান পুরোপুরি পূরণ করতে না পারলেও সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু সেই প্রতিবেদন প্রকাশের এক মাসের মাথায় দুবাইয়ে নারী পাচারের যে শক্তিশালী চক্রের অপকর্ম ফাঁস হলো তাতে পাচার রোধে অগ্রগতিই কেবল প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

দুর্ভাগ্যজনক হলো দেশের ভেতরে এই পাচারকারী চক্রের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর আগেভাগে জানা যায় না। জানা যায় যখন পাচার ও প্রতারণার শিকার নারী ও পুরুষ বিদেশে গিয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির শিকার হন। কয়েক দিন আগে ভিয়েতনামে ২৭ বাংলাদেশির আটকে পড়ার ঘটনায় বেরিয়ে আসে, ২০১৮ সাল থেকে একটি চক্র সেখানকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নামে বহু বাংলাদেশি নাগরিককে পাচার করে আসছে। তারা গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে লোকজনকে মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁদে ফেলে চাকরিপ্রার্থীদের ভিয়েতনামে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ দূতাবাস কিছু লোককে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এখনো অনেকে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন সেখানে। এর আগে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কুয়েতে গ্রেপ্তার হন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য শহিদ ইসলাম। মানব পাচারবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবেই কুয়েত সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। 

তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র দুবাইয়ে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা আজম খান সেখানে হোটেল ব্যবসার নামে বাংলাদেশ থেকে এক হাজারের বেশি নারীকে নিয়ে গিয়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করেছেন। আজম খান দুবাইয়ে চারটি হোটেলের মালিক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর নিয়োজিত দালাল চক্র এসব হোটেলে চাকরি দেওয়ার নাম করে নারীদের দুবাইয়ে পাঠাত। সাধারণত নিয়োগকারী সংস্থাগুলো বিদেশগামী লোকদের কাছ থেকে টাকা নেয়। এখানে উল্টো বিদেশগামীদের আগাম টাকা দেওয়া হতো। আট বছর ধরে আজম খান এই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন এবং সেখানে তাঁর টর্চার সেলও আছে। যেসব নারী তাঁর কথামতো চলতেন না, তঁাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। সম্প্রতি দেশটির পুলিশ বিভাগ
আজম খানের অপকর্মের কথা জানতে পেরে তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে তাঁকে দেশে পাঠিয়ে দেয়। তারা বিষয়টি বাংলাদেশ দূতাবাসকেও জানায়। অবশেষে নারী পাচারকারী চক্রের হোতা আজম খানসহ তিনজন সিআইডির হাতে ধরা পড়েছেন। 

অপরাধ দমনে দেশে অনেক বাহিনী কাজ করছে। গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে। তারপরও এত বড় ঘটনা তাদের কারও নজরে পড়ল না? এটি সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতা, না শর্ষের ভেতরেই ভূত আছে? একের পর এক মানব পাচারের যে ঘটনা ঘটে চলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো কোনোভাবে তার দায় এড়াতে পারে না। অতীতে আমরা দেখেছি, যখন কোনো অপরাধী চক্র ধরা পড়ে, তখন তাদের নিয়ে কিছুদিন তৎপরতা চলে। তারপর সবাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বর্তমান ক্ষেত্রে তেমন হবে কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে। 

দুবাইয়ে থাকা পাচারকারী চক্রের অন্য সদস্যদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে বলে জানিয়েছে সিআইডি। এটি সময়সাপেক্ষ। তার আগে তাদের কর্তব্য হবে আজম খানের দালাল হিসেবে যাঁরা দেশের ভেতরে কাজ করেছেন, তঁাদের ধরা। যেসব নারীকে দুবাইয়ে পাচার করা হয়েছে, অবিলম্বে তঁাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। মানব পাচার রোধে একাধিক আইন আছে। বিভাগীয় শহরে বিশেষ আদালত করা হয়েছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে কেউ মানব পাচারের মতো দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই।