দুর্নীতির বিষবৃক্ষ ফুলে-ফলে-পল্লবে বেড়েই চলেছে

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী, সবচেয়ে বিপজ্জনক গাছের তকমা মিলেছে ফ্লোরিডা এভারগ্লেড ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ম্যানচিনেলা বা বিচ অ্যাপলগাছের। এই গাছের শাখা-প্রশাখা, পাতা, এমনকি ফল পর্যন্ত সবই বিষাক্ত। মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। আবার বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস বিষবৃক্ষতে আমরা দেখি, বিষবৃক্ষের বীজ কখন অজ্ঞাতসারে মনের মাটিতে উপ্ত হয়, তা আমরা বুঝতে পারি না। যখন সে তরু পুষ্পিত-পল্লবিত হয়ে আমাদের সৎবোধ ও বিবেকবৃত্তি হরণ করতে উদ্যত হয়, তখনই আমাদের চেতনা হয়। তখন অনুতাপ ছাড়া আর কিছুই হাতে থাকে না।
আজকের বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় দুর্নীতির বিষবৃক্ষ। এর সাম্প্রতিক ফল পাপিয়া (ওয়েস্টিন), সাংসদ শহিদ (কুয়েত), সম্রাট (ক্যাসিনো), শামীম (ঠিকাদার), সাহেদ (রিজেন্ট) ও সাবরিনা (জেকেজি) আমাদের দেশ, সমাজ, অর্থনীতিকে বিষাক্ত করে তুলেছে।
আগে অর্থনীতিবিদেরা কেউ কেউ দুর্নীতিকে শুধু এক হাত থেকে আরেক হাতে সম্পদের অক্ষতিকর হস্তান্তর, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার লুব্রিকেন্ট হিসেবে, এমনকি প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহের ক্ষেত্রে জন্য অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষত কোভিড-১৯ মহামারিকালে দুর্নীতি সম্পর্কে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে দুর্নীতি অনুৎপাদনশীল ক্রনিদের হাতে সম্পদ হস্তান্তর করে, সিন্ডিকেট সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিযোগিতাকে ব্যাহত করে উন্নয়ন–প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এর মাধ্যমে দেশের বাইরে পুঁজি পাচার হয়ে যায়। দুর্নীতির তথাকথিত ধনাত্মক প্রভাবের পরিবর্তে এটা এখন প্রবৃদ্ধি, এমনকি অবৈধ মানব পাচার, ভুয়া কোভিড–১৯ পরীক্ষা সনদ ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনসংহারী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দুর্নীতির বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের দুর্নীতির খবর এখন দেশে আর উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে না। দেশের বাইরের সংবাদসূত্র থেকে আমরা এর কথা জানতে পারছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি ফিলিপাইন ইনকোয়ারার থেকে। অবৈধ মানব পাচারসংক্রান্ত খবর আসে ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি, লিবিয়ায় প্রাণহানি ঘটলে এবং অতিসাম্প্রতিক সাংসদ শহিদের কাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারি কুয়েতি কর্তৃপক্ষের হাতে তাঁর আটকের পর। এর একটা কারণ হলো দেশের সাংবাদিকদের একটি অংশ এখন হয় পোষমানা হয়ে গেছেন অথবা নিজেরাই দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েছেন। যে দু-একজন এর ব্যতিক্রম, তাঁরা নিগ্রহের শিকার।
কিছু দুর্নীতি উন্মোচিত হলেও অধিকাংশ দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ এখনো আমাদের অজানা। যেমন আমরা পাকিস্তান ও ভারতে ভুয়া পাইলট লাইসেন্সের কথা জেনেছি। এর কারণ হলো দুর্নীতিবাজেরা তাদের কর্মকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংবাদমাধ্যমকে হাত করে রাখে। ফলে তাদের অপকর্ম প্রকাশ পায় না। চুনোপুঁটি দু-একজন ধরা পড়লেও তাদের নিবর্তক শাস্তি হয় না। তারা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যায়। আর রুই-কাতলারা অধরাই থেকে যায়!
সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, আমলা, সাংবাদিকেরা দুর্নীতি সম্পর্কে আমাদের নসিহত করছেন। রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির নায়ক সাহেদ করিমকে চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় দুর্নীতি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ দুর্নীতি আলোচনার অ্যাজেন্ডাটিও এখন হাইজ্যাক হয়ে গেছে। ফলে দুর্নীতি বিষয়ে কোনো অর্থবহ আলোচনাও আর সম্ভব হচ্ছে না।

পে কমিশন
একসময় ধারণা করা হতো, নিম্ন বেতন-ভাতা ও সুবিধাদির কারণে আমলারা দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। তাই পে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বেতন, ভাতা ও অন্য সুবিধাদি বহুলাংশে বৃদ্ধি করা হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণের মূল্যায়ন করে সাধারণ মানুষ এখন বলছেন, বেতন-ভাতা ও অন্য সুবিধাদি বৃদ্ধির পর তঁাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতা দুটিই বেড়েছে! অথচ আশা করা হয়েছিল যে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি বাড়ালে দুর্নীতি কমবে ও দক্ষতা বাড়বে।

দুর্নীতি দমন কমিশন
সাধারণ মানুষ মনে করে, তাদের ভরসার স্থল দুর্নীতি দমন কমিশন এখন আর কার্যকর নয়। আমরা পদ্মা সেতুর ওপর লেখা সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া এনডিসির বই থেকে জানতে পারি, ইশারা না পাওয়া পর্যন্ত দুদকের মামলায় তাঁর জামিন হয়নি। অর্থাৎ কমিশন নিজস্ব প্রক্রিয়ায় নয়, বরং ইশারায় চলে। দুদকের সাফল্য এখন মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সীমাবদ্ধ, বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। বাড়তি অভিযোগ আছে, দুদক এখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। দুদকের পূর্বসূরি দুর্নীতি দমন ব্যুরোর একসময়ের মহাপরিচালক ছিলেন সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান। তাঁকে প্রধান কাজ কী জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, নিরীহ মানুষকে নিজ দপ্তরের হয়রানি থেকে বাঁচাতেই তাঁর বেশি সময় ব্যয় করতে হয়।
দুদক ও প্রশাসন স্বচ্ছ হলে বাস্তবে এর প্রতিফলন থাকত। সাধারণের ধারণা, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুদক কিছুটা কার্যকর হয়েছিল। তখন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক একবার আমার দপ্তরে এসে ক্ষুদ্র আইপিপি টেন্ডারের সময়সীমা বাড়াতে বলেন। আমি তাঁকে বলি, আপনি তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বা এ খাতে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আপনি বরং যারা দরপত্র দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ব্যবসাটি শিখতে চেষ্টা করুন। তিনি পীড়াপীড়ি করতে থাকলে আমি তাঁকে বলি, আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি বিশাল। ভবিষ্যতে আরও হাজার হাজার মেগাওয়াটের টেন্ডার হবে। আপনার তাড়া কিসের? তিনি বলেন, এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্রয়াদেশ পেতে ঘুষ দিতে হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষণস্থায়ী। তাই এখনই তিনি অংশ নিতে চান। আমি দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটানোর জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় টেন্ডারের সময়সীমা বাড়াতে অপারগতা জানাই। তিনি আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি দরপত্র প্রদানকারী অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন।

তবে কি বিকেন্দ্রীকরণই সমাধান?
গত প্রায় ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে এককেন্দ্রিক সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থা দিয়ে দুর্নীতির বিষবৃক্ষের ডালপালা বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতায়ন করে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার বিষয় বিবেচনা করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিটি বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সম্প্রতি মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আইনগত ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নন এবং নিউইয়র্কের অভিশংসককে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ট্যাক্স রিটার্ন দেখতে পারবে বলে রায় ঘোষণা করেছেন, যদিও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিধায় মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদকে একই সুবিধা দেওয়া হয়নি। এমনই নিরপেক্ষতা বিচার বিভাগের এবং এমনই ক্ষমতা স্থানীয় আইন কর্মকর্তার।
চার শল্যবিদের গল্প বলে শেষ করি। তাঁরা কে কোন ধরনের রোগীর অস্ত্রোপচার করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তা নিয়ে মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে আলাপ করছিলেন। প্রথমজন বললেন, আমি লাইব্রেরিয়ানদের পছন্দ করি। কেননা, তাদের খুললেই দেখতে পাই সবকিছু বর্ণমালা অনুযায়ী সাজানো। দ্বিতীয়জন বললেন, আমার পছন্দ হিসাবরক্ষক। কেননা, তাদের খুললেই দেখি সবকিছু সংখ্যায় সাজানো। তৃতীয়জন বললেন, আমার পছন্দ বৈদ্যুতিক কর্মী। কেননা, সবকিছুই লাল, নীল, সাদা, কালো রঙে চিহ্নিত। চতুর্থ শল্যবিদ বললেন, না না, রাজনীতিবিদদের অস্ত্রোপচার সবচেয়ে সহজ ও সর্বোত্তম। বাকিরা তিনজন একে অন্যের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেন? চতুর্থ শল্যবিদ বললেন, কেননা, তাদের হৃদয়, মেরুদণ্ড ও বিবেক নেই, এবং তাদের মস্তিষ্ক ও পশ্চাদ্দেশ পরস্পর অদলবদলযোগ্য।
আমি নিশ্চিত, এটা নিছক গল্প এবং দেশে-বিদেশে স্বল্পসংখ্যক হলেও নীতিমান রাজনীতিবিদদের জন্য অবমাননাকর। তবে সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করে, দুর্নীতির বিষবৃক্ষটিকে নিধন করতে হলে, নিদেনপক্ষে এর বিস্তার রোধ করতে হলে পরিবর্তনটা এখান থেকেই শুরু করতে হবে। কেননা, অর্থবহ রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমনে সফলতা অর্জন সম্ভবপর নয়।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও
অর্থনীতিবিদ