দুই কদম এগিয়ে দশ কদম পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা

দুর্যোগ বা বিপর্যয় যে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে প্রভাবিত করে না, তা গত কয়েক মাসে অনেকবারই আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। স্বাভাবিক সময়ে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ নারী ঘরে-বাইরে নানা সহিংসতার শিকার হন; চলমান করোনা মহামারির সময়ে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা গেছে। কোনো কোনো দেশে তিন গুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এপ্রিলের শুরুতে করোনা বিপর্যয়ে নারীর প্রতি সহিংসতাকে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। জাতিসংঘ বলে চলেছে করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতিতে যেন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাংলাদেশে স্বাভাবিক সময়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার উচ্চ প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে করোনা-সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু গত কয়েক মাসের পত্রপত্রিকা ও সরকারি ওয়েবসাইটগুলো থেকে পাওয়া তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকিকে খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। করোনা মোকাবিলায় যে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে আমার জানামতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যারা বিভিন্ন মানবাধিকার বা উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে মাঠপর্যায়ের তথ্য রাখেন, তাঁরাও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে মহিলাবিষয়ক সরকারি দপ্তরগুলো বেশির ভাগই ত্রাণসংক্রান্ত বিষয়ে সক্রিয়; নারী ও শিশুদের নিয়ে কার্যক্রমগুলো চলছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও ঢিমেতালে।

করোনা বিপর্যয়ের এই পর্যায়ে অন্তত নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নতুনভাবে ভাবতে হবে। দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির ঝুঁকির ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থাগুলোই সরব বেশি। কিন্তু এই বিশেষ ঝুঁকিকে মোকাবিলা করতে হলে সরকারি সংস্থা ও সেবাগুলোকেই সব উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে হবে। এই বিপর্যয় শুধু স্বাস্থ্য বা অর্থনীতির জন্যই ঝুঁকি, এটি চিন্তা করে নীরব থাকলে চলবে না। ভাবতে হবে নতুন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কীভাবে দমন করা যেতে পারে। 

এ বিষয়ে অবশ্যই বৃহৎ পরিসরে আন্তমন্ত্রণালয় আলোচনা প্রয়োজন; আলোচনায় নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা সাপেক্ষে একটি নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রয়োজন করোনা সংকটের সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতার সম্পর্ক জাতীয় পর্যায়ে অনুধাবন করা। এটা অনুধাবন করা জরুরি এ জন্য যে নারীর আইনি অবস্থানবিষয়ক গবেষণার কাজগুলো থেকে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, নারী যে সহিংসতার শিকার হতে পারে, এটি তথ্য-উপাত্তে সত্য হলেও অনেকেই এই সত্য আমলে নেন না। আর এখন করোনার মহাদুর্যোগে, যখন আমরা স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম আর অর্থনীতির সম্ভাব্য বিপর্যয় নিয়ে চিন্তিত, তখন নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি যে একেবারেই নিগৃহীত হবে, এমনটাই ধারণা করা যায়। 

তাই সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে প্রতিটি সেবা সংস্থা ও দপ্তরে এই বার্তা স্পষ্ট করা যে করোনাকালীন দুর্যোগ নারী ও শিশুকে অনেক বেশি সহিংসতার ঝুঁকিতে ফেলেছে। তাই মহামারি চলাকালে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুর জন্য প্রযোজ্য সব সুরক্ষা ও সেবাকে তাই জরুরি সেবা হিসেবেই ধরতে হবে।

এর পাশাপাশি করোনাকালে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য সারা দেশের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রটোকল মেনে চলতে যথাযথ নির্দেশনা প্রয়োজন। আমার জানামতে, কয়েকটি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার পুরোপুরিভাবে করোনা হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ প্রশাসনিক নির্দেশনার প্রয়োজন, যাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা যায়। বিশেষ করে ধর্ষণের শিকার নারীর থানায় অভিযোগ গ্রহণ, ডাক্তারি পরীক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে করোনাকালে কী বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, সেটিও আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বিভাগীয় শহরগুলোর নারী সহায়তাকেন্দ্র এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকেও আমরা এ বিষয়ে কিছু ধারণা নিতে পারি। ফ্রান্স, স্পেনসহ কয়েকটি দেশে ওষুধের দোকানে কোনো নারী একটি বিশেষ পূর্বনির্ধারিত সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করলেই ওষুধ বিক্রেতা ধরে নেবেন যে ওই নারী ঘরে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন এবং তাঁকে পুলিশি সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। অনেক দেশে প্রথম সারির স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা ত্রাণ বিতরণকারী ব্যক্তিদের নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিছু নতুন মোবাইল অ্যাপের ব্যবহারও করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে সহিংসতার শিকার নারী গোপনে ফোনের মাধ্যমে নিকটস্থ সুরক্ষাকেন্দ্রে বা থানায় বিপৎসংকেত পাঠাতে পারেন।

করোনাকালে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিপর্যয়ের নতুন দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। কিছু পরিকল্পনা অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবে প্রয়োজন অর্থ বরাদ্দ করা না হলে কর্মপরিকল্পনা কাগজে-কলমেই রয়ে যাবে। তাই অর্থ বরাদ্দের বিষয়টিতেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।

করোনা যে নারীকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এই অনুধাবন যত দ্রুত আসবে, ততই মঙ্গল। করোনার পরের সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা রুখতে পুরোনো ভোঁতা ঢাল-তলোয়ার দিয়ে ‘নতুন স্বাভাবিক’ সময়কে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এখনই প্রস্তুতি না নিলে আগামী দিনগুলোতে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবস্থা হবে দুই কদম এগিয়ে গিয়ে দশ কদম পিছিয়ে পড়ার মতো।

তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক