কারও নজরে নেই স্বাস্থ্যকর্মীরা

অনেকে ভেবেছিলেন, মহামারির তীব্রতা একসময় প্রত্যেককেই চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তা ও তাঁদের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব বুঝতে সহায়তা করবে। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ কদর পাবেন। কিন্তু সে ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। 

করোনাভাইরাস আগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্রতা নিয়ে ছড়াচ্ছে এবং এই মহামারি মোকাবিলায় যাঁরা সামনের সারিতে থেকে কাজ করছেন, সেই স্বাস্থ্যকর্মীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন—এই বাস্তবতার পরও সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। এই মহামারির কারণে অর্থনীতি ও শ্রমবাজার যখন ভেঙে পড়ছে, তখন বিশেষ করে বেসরকারি খাতের চাকরিদাতাদের কর্মীদের সঙ্গে আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর হতে দেখা যাচ্ছে। 

পুঁজিবাদ বরাবরই নারী, অভিবাসী এবং সামাজিকভাবে কোণঠাসা মানুষের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে শ্রম কিনে নেওয়ার ওপর নির্ভর করে থাকে। তঁাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে সুযোগ-সুবিধা থেকে তাঁদের বঞ্চিত রাখার মধ্যেই পুঁজিবাদের মূল উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। এই মহামারিতে ঠিক সেই বিষয়টিই প্রতিভাত হচ্ছে। এমনকি স্বাস্থ্যসেবা খাতেও সেই ছবি দেখা যাচ্ছে। 

এই করোনাকালে সামাজিক সেবায় নিয়োজিত মানুষেরাই এখন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। এটি পারিবারিক জীবনেও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। একটি পরিবারের সাংসারিক কাজ দেখাশোনায় সবচেয়ে ভূমিকা রাখেন পরিবারের নারী ও মেয়েরা। কিন্তু সেই কাজকে কাজ বলেই স্বীকার করা হয় না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবেও এগুলোকে গণ্য করা হয় না। এরই ধারাবাহিকতায় নারীরা উৎপাদনমূলক কোনো কাজে যোগ দিলে সেখানেও তাঁকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। 

শ্রমবাজারে নারীদের পুরুষের চেয়ে অনেক কম মজুরি দেওয়া হয়। তাঁদের কম টাকা এ জন্য দেওয়া হয় না যে তাঁরা পুরুষের চেয়ে কম কাজ করেন বা খারাপ মানের কাজ করেন, আসলে তাঁরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি সহজলভ্য শ্রমিক। সাধারণত বড় বড় পদে পুরুষেরা থাকেন। তাঁরাই নীতিনির্ধারণের কাজ করেন। 

স্বাস্থ্য খাতও এর বাইরের কিছু নয়। স্বাস্থ্য খাতেও শ্রেণিবিন্যাসের বিষয় জোরালোভাবে আছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে শুরু করে নার্স, ওয়ার্ড অ্যাটেনডেন্ট এবং ক্লিনার পর্যন্ত তাকালে দেখা যাবে, সেখানেও একেবারে নিচের দিকের সারিতে নারীর সংখ্যা বেশি। 

সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা খাতের মোট জনশক্তির ৭০ শতাংশ নারী। তবে তাঁরা বেশির ভাগই নার্স, ধাই এবং কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, যেখানে সার্জন, সাধারণ চিকিৎসক, ডেন্টিস্ট এবং ফার্মাসিস্টের বেশির ভাগই পুরুষ। কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা খাতে যঁারা কাজ করেন, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এই খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অমানবিক জীবন যাপন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে স্বীকারই করা হয় না। ভারতে একেবারে প্রান্তে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের, বিশেষ করে নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘স্বেচ্ছাসেবী’ বলে ডাকা হয়। তঁাদের এই কাজকে সাধারণ চাকরি হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কোনো জব সিকিউরিটি নেই, অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে ‘নো ওয়ার্ক নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে কাজ করতে হয়।

নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের এই মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের সবচেয়ে বেশি রোগীদের সরাসরি সংস্পর্শে গিয়ে কাজ করতে হয়। করোনা মহামারির শুরুর দিকে এই স্বাস্থ্যকর্মীদের সামাজিকভাবে ‘অচ্ছুত’ হওয়ার জোগাড় হতে হয়েছিল। তিনি চিকিৎসাসেবায় আছেন শুনলেই প্রতিবেশীরা তাঁদের এড়িয়ে চলত। সারা বিশ্বেই রাজনৈতিক নেতারা এসব স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশংসায় হাততালি দিয়েছেন, তঁাদের উৎসাহ দিতে গিয়ে গান গেয়েছেন এবং কোনো স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেলে হাসপাতালের বাইরে ফুল রেখে তঁাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কিন্তু আর্থিকভাবে তাঁদের পাশে রাজনীতিকেরা দাঁড়াননি। 

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম দিকে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো সামনের দিকে থাকা সেবাকর্মীদের বেতন কিছুটা বাড়িয়েছিল। এখন আবার তা আগের অবস্থায় নিয়ে এসেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসায় যে দুজন অভিবাসী নার্স নিয়োজিত ছিলেন, সুস্থ হয়ে তাঁদের প্রশংসা করেছেন। তবে এই করোনার মধ্যেও অভিবাসীদের ওপর সারচার্জ বসাতে তিনি পিছপা হননি। 

উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থা অবর্ণনীয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী নেই। জীবন হাতে নিয়ে তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে। বহু বেসরকারি ক্লিনিক ও সেবাকেন্দ্রে কর্মরত সেবাকর্মীদের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতে চিকিৎসকেরা এই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কঙ্গোতে বেতন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা ধর্মঘট করেছেন। 

স্বাস্থ্যকর্মীরা এই অবহেলার মধ্যে থাকলেও সেভাবে তাঁরা আলোচনায় উঠে আসছেন না। এই অবস্থা বেশি দিন দীর্ঘায়িত হলে মহামারি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ দিকে যেতে পারে। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো বাড়ছে। এ অবস্থায় সেবা খাত থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা সরে গেলে তার খেসারত সবাইকে দিতে হবে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জ্যোতি ঘোষ দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক