ভুল সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত

ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৫ কিমি দূরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত আদমজী ইপিজেড। সবাই কম–বেশি জানেন যে একসময় ছিল এখানে পৃথিবীর অন্যতম বড় পাটকল, আদমজী জুট মিলস।

১৯৫০ শতকের শুরুর দিকে আদমজী গ্রুপ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদমজী জুট মিলস বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত লাভজনক ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এটি জাতীয়করণ করা হয়। আদমজীসহ আরও প্রায় ৮২টি বেসরকারি পাটকলকে জাতীয়করণ করে এগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৪ সালে বিজেএমসি গঠন করা হয়। শুরু থেকেই এই পাটকলগুলো চরম অব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে। এক হিসাবে দেখা যায় ৪৪ বছরের ইতিহাসে এই পাটকলগুলো শুধু চার বছর লাভের মুখ দেখেছে। গত এক যুগে শুধু একবার সরকারি পাটকলগুলো ২০১১ সালে ১৭ কোটি টাকা লাভ করেছিল। অন্যদিকে এই পাটকলগুলোর পেছনে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গচ্চা গেছে।

২০০২ সালে বিএনপি সরকার আদমজী জুট মিল বন্ধ ঘোষণা করে সব শ্রমিক–কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে। এর জন্য তখনকার সরকারের শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচি বাবদ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তখন আদমজী জুট মিলে প্রায় ২৫ হাজারের ওপরে শ্রমিক কাজ করতেন। জুট মিল বন্ধ হয়ে যখন আদমজী ইপিজেড হিসেবে আবির্ভূত হলো তখন শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০০৫–এর দিকে সেখানে কর্মরত জনশক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র দেড় হাজারের মতন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন সেখানে প্রায় ৬২ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। ২০১৯ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী এই ইপিজেড থেকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি হয়েছে।

আদমজী জুট মিলের মতনই ২০২০ সালের ১ জুলাই সরকারি মালিকানাধীন ২৬টি পাটকল বন্ধের ঘোষণা এসেছে। আদমজী জুট মিলের মতনই এই পাটকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে আসছিল। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই পাটশিল্পের পুনরুত্থান ঘটানোর একটা আওয়াজ তুলেছিল। সেই সময়ের নির্বাচনী ইশতেহারে পাটশিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা–ই নয়, ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিজেএমসির পেছনে ব্যয় করেছিল পাটের বাজারকে চাঙা করার জন্য। বেসরকারি খাতে থাকা কয়েকটি কারখানা আবার ফিরিয়েও আনা হয়েছিল।

শুরুর দিকে এসব কার্যকলাপ সবার মাঝে বেশ আশার সঞ্চার করেছিল। এর মাঝখানে ২০১০ সালে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কৃত হয়। সেই সঙ্গে পাটের পাতা ভেষজ, পলিথিনের বিকল্প পাট ইত্যাদি প্রচার করে পাটের সুদিন ফিরে আসছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল। এর পালে আরও জোরে হাওয়া লাগে, যখন ২০১১ সাল বিজেএমসি সাড়ে ১৭ কোটি টাকা লাভ করে।

পাটশিল্পের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সুখবরের শুরু এবং শেষ ওই ২০১১ সালেই। কারণ শুরুর দিকের আগ্রহ, উত্তেজনা মিইয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এর একটি বড় কারণ হলো পাটশিল্পকে কীভাবে কার্যকর বাজার কাঠামোতে আনা যায়, সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো টেকসই পরিকল্পনা ছিল না। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থাপনা এখানে ছিল না। সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা যায় যে বিজেএমসির প্রশাসনিক কাঠামোতে কোনো দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্ব ছিল না। কোনো চেয়ারম্যান ১৩ মাসের বেশি এখানে থাকেননি। পরিচালকেরা আরও কম ছিলেন।

এর ফলে গত এক যুগে পাটের সুদিন ফিরে আসছে বলে বারবার ধুয়া তোলা হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গত তিন বছরে কী ঘটেছে, সেই সম্বন্ধে শাহানা শারমিন, পাটকল সংগ্রাম পরিষদের নেত্রী বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলছিলেন, ‘গত তিন বছর ধরে পাট কেনা বন্ধ, পাটের সাথে আনুষঙ্গিক জিনিস না কিনে শ্রমিকদের শুধু বসায়ে বসায়ে পয়সা দিছে। আমাদের লস হচ্ছে শুধু এই জিনিসটাই চারদিকে তুলে ধরছে। ২০১৬ সালের পর থেকেই এ রকমই চলে আসছে। আমাদের পণ্য দেশেই সেল করার উদ্যোগ নিলে এ রকম হতো না।’

শাহানা শারমিনের কথা কিন্তু মোটেও অযৌক্তিক নয়। বাংলাদেশ যে পরিমাণ পাট তৈরি করে, তার প্রায় ৯০ ভাগই দেশীয় বাজারে বিক্রি হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েও বিদেশে যেটুকু রপ্তানি হয়, সেটি বিশ্বব্যাপী রপ্তানি বাজারের প্রায় ৮০ ভাগ। তা ছাড়া বাংলাদেশে যে পরিমাণ পাট উৎপন্ন হয়, তার প্রায় ৯৫ ভাগই বাংলাদেশি বেসরকারি খাতে পাটকলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে। সরকারি খাতের এ ২৫টি পাটকলের তাতে অবদান ছিল মাত্র মাত্র পাঁচ ভাগ।

এ রকম পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের অর্থবছরেই ৪৮০ কোটি টাকা আবারও সরকারি পাটকলগুলোকে দেওয়া হয়েছিল ক্ষতির ধাক্কা সামলিয়ে বেতন–দেনা ইত্যাদি পরিশোধ করতে। ঠিক তার পরের অর্থবছরেই পাট মন্ত্রণালয় আবার ৫০০ কোটি টাকা দাবি করে দেনার খাতা সামলাতে। এই প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন ‘আমরা এই বিশাল পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর জন্য বছর বছর ব্যয় করতে পারি না যেখানে বেসরকারি পাটকলগুলো লাভজনক ব্যবসা করে চলেছে।’ (ঢাকা ট্রিবিউন, ৩ এপ্রিল, ২০১৯)। সরকারি পাটকলগুলো এভাবে বছরের পর বছর অদক্ষ পরিচালনা, দুর্নীতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। আর এর পুরো ভার বহন করছে জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা।

বিভিন্ন সচেতন নাগরিক এবং শ্রমিক অধিকার সংগঠন এই পাটকল বন্ধের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এটাও সত্যি যে এই পাটকলগুলো বন্ধ হলে পূর্ণকালীন ২৫ হাজার শ্রমিক এবং অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা বেশ বিপদে পড়বেন। শুধু তা–ই নয়, এই করোনাকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে এই অপ্রীতিকর সিদ্ধান্তটি আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে। কিন্তু এই শ্রমিকেরা কিন্তু খালি হাতে ফিরছেন না। সরকার বকেয়া বেতন এবং গোল্ডেন হ্যান্ডশেক মারফত প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে যাচ্ছে।

আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এই পাটকলের শ্রমিকদের চেয়ে অনেক বেশি বিপদে আছেন এই দেশের অন্যান্য খাতে কর্মরত শ্রমিকেরা। যেসব গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যেসব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা গুটিয়ে আনা হচ্ছে; সেই শ্রমিক–কর্মচারী কাউকেই কিন্তু গোল্ডেন তো দূরের কথা, কোনো রকম হ্যান্ডশেকই তাঁদের প্রতি দেওয়া হচ্ছে না। এক দিনের নোটিশে বা একটি ফোন কল দিয়ে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এই ধরনের ভুক্তভোগী কর্মজীবী মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আরও বেশি জরুরি এই মুহূর্তে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি হলো যে সরকারে দ্বারা পরিচালিত ব্যবসা অন্তর্গতভাবেই ব্যর্থ হওয়ার কথা। লাভের জোরালো প্রণোদনা ছাড়া কোনো ব্যবসা সফল হয় না। সরকারি কাঠামোতে সেই প্রণোদনা অনুপস্থিত। বাংলাদেশে সরকারি খাতে থাকা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই লাভজনক নয়। সরকারের মূল কাজ হলো ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। ব্যবসার মাঠে রেফারির ভূমিকা পালন করা, খেলার নিয়ম সবাই মেনে চলছে কি না, ফাউল হলে শাস্তির বিধান করা। রেফারির বাঁশি হাতে নিয়ে রেফারি নিজেই খেলতে নামলে সেটি খেলার মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।

তাছা ড়া যেই দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে, দুর্নীতি দমনে বিশেষ কোনো সুনাম নেই, সেই দেশে সরকারের পরিচালনায় যত কম ব্যবসা থাকে, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। তাই পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত অবশ্যই একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটি ভুল সময়ে নেওয়া হয়েছে। এটি অনেক বছর আগেই কার্যকর করা উচিত ছিল। এখন করোনাকালীন বিপর্যয়ে এ সিদ্ধান্তটি একটি নিষ্ঠুর পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে।

রুশাদ ফরিদী: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়