বিশ্ব সুরক্ষার স্বার্থে ইরান চুক্তিকে বাঁচাতে হবে

এএফপি ফাইল ছবি
এএফপি ফাইল ছবি

আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগের এই সপ্তাহে ভিয়েনায় ই৩ /ইইউ‍+৩ (চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়ান ফেডারেশন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিটি পলিসি) এবং ইরানের মধ্যে জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) শীর্ষক একটি চুক্তি হয়েছিল। সংক্ষেপে এটিকে অনেকেই ইরান চুক্তি বলে উল্লেখ করে থাকেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পঞ্চম বার্ষিকীতে আমাদের যে সাধারণ বাস্তবতা ও সত্য মেনে নিতেই হবে, সেটি হলো এই চুক্তি না হলে ইরানের হাতে এত দিনে পারমাণবিক অস্ত্র চলে যেত। এতে গোটা অঞ্চলে আবার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হতো। 

আজ সেই জেসিপিওএ নানা দিক থেকে কঠিন চাপে আছে। যেকোনো সময় তা ভেঙে পড়তে পারে। আমি মনে করি, অন্তত দুটি কারণে এই চুক্তি জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর রাখা শুধু প্রয়োজন নয়, বরং অতি জরুরি। 

প্রথম কারণ হলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ইরানের বিভেদ দূর করে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ১২ বছর সময় লেগেছে। এখন এই জেসিপিওএ যদি ভেস্তে যায়, তাহলে ইরানকে পরমাণু অস্ত্র বানানো থেকে ফিরিয়ে রাখার কোনো আন্তর্জাতিক বিকল্প বৈধ পথ আর খোলা থাকবে না। ইরানের পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আলোচনার একটি উদ্যোগ নেন। অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর অবশেষে জেসিপিওএ বাস্তবায়িত হয়। কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের একার নয়, রাশিয়া, চীন এবং অবশ্যই ইরানের সম্মিলিত ছাড় দেওয়ার ফল হিসেবে এটি সম্ভব হয়েছিল। 

এক শ পৃষ্ঠার এ চুক্তি ছিল অকাট্য দলিলের মতো। এতে স্পষ্ট শর্ত দেওয়া আছে পরমাণুসংক্রান্ত যেসব অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর আরোপ করা হয়েছিল, তা তুলে নেওয়ার বিনিময়ে ইরান তার পরমাণু কার্যক্রম বিশ্বনেতাদের বেঁধে দেওয়া মাত্রায় চালাবে। এরপর জেসিপিওএ নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনে রূপ পায়। এত কাঠখড় পুড়িয়ে এমন একটি চুক্তিতে আসার পর সেটি ভেস্তে যেতে দেওয়া কারও জন্য সুফল বয়ে আনবে না। 

দ্বিতীয় কারণ হলো ইরান চুক্তিটি কেবল কোনো প্রতীকী সাফল্যের নিদর্শন নয়। এর মধ্যে যে প্রতিশ্রুতির কথা রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই সুফল দিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইরানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছে এবং তারা বলেছে, ইরান তার কার্যক্রম সীমিত করার যে শর্ত মানতে রাজি হয়েছিল, তা তারা মানছে। ইউরোপীয় দেশগুলো চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে এবং তেহরান বাকি বিশ্বের সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্য করার সুযোগ পেয়েছে। 

কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র তার পশ্চিমা মিত্রদের শত অনুরোধ পায়ে দলে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আগের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান চুক্তি ভেঙে দেওয়ায় ইরান চাইলে আবার তার পরমাণু কার্যক্রম শুরু করতে পারত। কিন্তু চুক্তির অন্য পক্ষগুলো, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুরোধে ইরান সেই চুক্তি পরবর্তী ১৪ মাস মানবে বলে জানায়। সে মোতাবেক তারা চুক্তির শর্ত মেনেও এসেছে। কিন্তু এখন আবার জেসিপিওএ হুমকির মুখে পড়েছে। ইরান আবার পরমাণু কার্যক্রম চালু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

জেসিপিওএর বর্তমান সমন্বয়ক হিসেবে আমি চুক্তির সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করা অব্যাহত রাখব, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও আমি যোগাযোগ রাখছি। গত পাঁচ বছরে আমাদের যে অর্জন তা অক্ষুণ্ন রাখতে আমরা তৎপর হব। আমাদের মনে রাখা দরকার, এই চুক্তি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে গত পাঁচ বছরে আমরা যা অর্জন করেছি, বিশেষ করে ইরানের পরমাণুসংক্রান্ত যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা তৈরি করতে পেরেছি, তা নস্যাৎ হয়ে যাবে। 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, জেসিপিওএ বৈশ্বিক অস্ত্র বিস্তাররোধ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার মতো একটি চুক্তি এবং এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বিশ্বের সব পক্ষের সহযোগিতা দরকার। বিশেষ করে ইরানকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষ থেকে ইরানের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা পড়েছে, তাতে ইরানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। চুক্তি টিকিয়ে রাখতে হলে ইউরোপের দেশগুলোকে ইরানের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ বোরেল ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক ও নিরাপত্তা নীতিসংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ও ইউরোপিয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট