কোরবানি যাঁর জন্য ওয়াজিব, যেভাবে করতে হবে

ইসলামে যত বিধান আছে, তার অন্যতম হলো কোরবানি। কোরবানি করা অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। এতে আছে আত্মত্যাগের মহিমা ও আর্তের সেবার গৌরব। আদি পিতা হজরত আদম (আ.)–এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকে শুরু হওয়া এই কোরবানির ইতিহাস মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)–এর মহান আত্মবিসর্জনে উজ্জ্বল, যা কিয়ামত পর্যন্ত অম্লান থাকবে। 

স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক, মুসলিম যদি ‘নিসাব’ পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাঁদের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব বা আবশ্যক। নিসাব হলো সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসার পণ্য বা সম্পদ। 

কোরবানি অর্থ হলো কাছে যাওয়া বা নৈকট্য অর্জন করা, ত্যাগ স্বীকার করা বা বিসর্জন দেওয়া। পরিভাষায় কোরবানি হলো জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শরিয়তের বিধান অনুসারে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। একটি কোরবানি হলো একটি ছাগল, একটি ভেড়া বা একটি দুম্বা এবং গরু, মহিষ ও উটের সাত ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ একটি গরু, মহিষ বা উট সাত শরিকে বা সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। 

কোরবানির পশু যেকোনো মুসলমান নারী ও পুরুষ জবাই করতে পারেন। যাঁর কোরবানি তাঁর নিজে জবাই করা উত্তম। দোয়া জানা জরুরি নয়। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করলেই হবে। এ ছাড়া অন্য দোয়া জানা থাকলে পড়া ভালো। জবাইয়ের জন্য কোনো নিয়ত নেই এবং কোরবানিদাতার নাম বলাও জরুরি নয়। যিনি কোরবানি দিচ্ছেন, তাঁর মনের ইচ্ছাই নিয়ত হিসেবে কবুল হবে। নিজে জবাই করতে না পারলে যেকোনো কাউকে দিয়ে জবাই করাতে পারেন। জবাইয়ের সময় নিজে উপস্থিত থাকতে পারলে ভালো। 

কোরবানির গোশত ধনী–গরিব সবাই খেতে পারেন। সুন্নাত হলো কিছু অংশ আত্মীয়স্বজনকে দেওয়া, কিছু অংশ গরিব পাড়া–প্রতিবেশীদের দেওয়া এবং কিছু অংশ নিজের পরিবারের জন্য রাখা। যত বেশি দেবে, তত ভালো। প্রয়োজনে সম্পূর্ণটাও রাখা যাবে। অনেকে সাত ভাগের এক ভাগ দিয়ে থাকেন, অনেকে সামান্য রেখে পুরোটাই দিয়ে দেন। ত্যাগের কোরবানির গোশত ভোগের জন্য পুঞ্জীভূত করে রাখা অনৈতিক ও অমানবিক। তবে বিশেষ কোনো ব্যক্তির জন্য বা শখের বশে অল্প পরিমাণে রাখলে কোনো দোষ নেই। 

ওয়াজিব কোরবানি ছাড়াও ছোট–বড় জীবিত–মৃত যেকোনো কারও পক্ষ থেকে যেকোনো কেউ নফল কোরবানি আদায় করতে পারেন। এতে উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবেন। নারী যদি সামর্থ্যবান বা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন, তাঁর পক্ষেও কোরবানি ওয়াজিব। শিশুদের ওপর কোরবানিসহ কোনো ফরজ ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়। হিজড়ারা মূলত নারী বা পুরুষ। তাই তঁারাও প্রাপ্তবয়স্ক এবং সামর্থ্যবান হলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো কোরবানিও ওয়াজিব হবে। গরু, মহিষ বা উট অংশ হিসেবে যেভাবে ভাগে একাধিকজনের পক্ষে কোরবানি দেওয়া যায়, সেভাবে একটিকে সাতটি ধরে অংশ হারে আকিকাও দেওয়া যায়। কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে করতে কোনো বাধা নেই। 

কোরবানি শুধু পশু জবাইয়ের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। কোরবানির কোনো বিকল্প নেই। টাকাপয়সা প্রদান, অর্থসম্পদ দান ও সদকা খয়রাতের মাধ্যমে কোরবানি আদায় হবে না। সামর্থ্যবান কোনো ব্যক্তি বিশেষ ওজরের কারণে নিজে কোরবানি সম্পাদনে সক্ষম না হলে অন্য কাউকে দিয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তা সম্পাদন করাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে পশুর মূল্য ও ব্যবস্থাপনার যাবতীয় ব্যয়ও তাঁকে বহন করতে হবে। কেউ যদি বিনা পারিশ্রমিকে করে দেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। 

যদি কেউ কোরবানির পশু কেনা, জবাই করা ও গোশত বিতরণ করা ইত্যাদি ঝামেলা এড়াতে চান, তবে বিশ্বস্ত কোনো ব্যক্তি-আত্মীয়স্বজন বা গ্রামের লোকজন অথবা নির্ভরযোগ্য কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সেবা সংস্থাকে তাঁর কোরবানি সম্পাদনের দায়িত্ব দিতে পারেন। 

কোরবানির পাশাপাশি অভাবী গরিব, দুঃখী, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে ঈদ আনন্দে শামিল করার জন্য বেশি বেশি আর্থিক দান–অনুদান, জামাকাপড় প্রদান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ঈদসামগ্রী কিনে দেওয়ার মাধ্যমে আরও বেশি পুণ্য অর্জন করা যায়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক 

smusmangonee@gmail,com