অক্ষয়কুমার দত্ত: সময়ের থেকে এগিয়ে

অক্ষয়কুমার দত্ত
অক্ষয়কুমার দত্ত

এ বছর ১৫ জুলাই অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। নামটা কি অপরিচিত মনে হচ্ছে? অন্য একটি পরিচয় দিলে অবশ্য চিনতে অসুবিধা হবে না। তিনি ‘ছন্দের জাদুকর’ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতামহ। স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে দীর্ঘদিন থেকে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে বলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আজ পিতামহের চেয়ে বেশি পরিচিত হতে পারেন, কিন্তু বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয় দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনো বহমান।

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। কথাটি অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কেও সমানভাবে সত্য। তিনি বিদ্যসাগরের পরম বন্ধু ছিলেন। তাঁরা দুজনই যুগপৎভাবে বাংলা ভাষা গদ্যের মজবুত ও আধুনিক ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ, একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ এবং প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী।

দুই.
বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলনে অক্ষয়। তাঁর পিতা কলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর অক্ষয় কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। কিন্তু অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, লাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।
ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। তখনো বিদ্যাসাগরের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই সেই ভাষার নমুনা:
‘যে বিদ্যা দ্বারা পৃথিবীর আকার পরিমাপ এবং তাহার উপরিভাগস্থ স্থান সমূহ সমুদয় জ্ঞাত হওয়া যায় তাহার নাম ভূগোল বিদ্যা।
‘ভূ শব্দের অর্থ পৃথিবী এবং গোল শব্দের অর্থ গোলাকার, অতএব গোলাকার পৃথিবী বিষয়ক বিদ্যাকে ভূগোল কহা যায়।
‘পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।’
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন যে তিনিই বাংলা ভাষাকে ‘সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য’ করে তুলেছিলেন এবং ‘গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা’—এই দুইয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। ‘ভূগোল’–এর ভাষা দেখে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ তাঁর জন্মের বিশ বছর আগে প্রকাশিত ও পরবর্তীকালে দুর্লভ এই গ্রন্থটি তখনো দেখেননি।

তিন.
অক্ষয়কুমার দত্ত ‘বিদ্যাদর্শন’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন কিছুদিন। তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্দেশ্যে লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ এই পত্রিকায় ছাপা হয় এবং অক্ষয় দত্ত তার সমর্থনে সম্পাদকীয় লেখেন। বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’
‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে প্রথম ব্যবহৃত—মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুব রেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ—ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি।
অক্ষয় দত্তের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়’। তাঁর বইগুলো কোনো না কোনো ইংরেজি গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত হলেও এই গ্রন্থে ভারতের উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর নিজের অনুসন্ধানলব্ধ তথ্য ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। বিখ্যাত জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্সমুলার এ বইটি পড়ে অক্ষয় দত্তকে চিঠি লিখেছিলেন।

চার.
অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এবং হয়তো বিদ্যাসাগরের সাহচর্যে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। বিদ্যাসাগর বেদান্ত-সাংখ্য দর্শনের মতো হিন্দুধর্মীয় দর্শনকে ভ্রান্ত বলেছিলেন। তেমনি অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। তবে অক্ষয় দত্ত তাঁর ঈশ্বরবিষয়ক একটি সমীকরণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। হিন্দু হোস্টেলের ছাত্ররা একবার তাঁর কাছে, প্রার্থনার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি একটি সমীকরণ দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন—
পরিশ্রম=শস্য
পরিশ্রম+প্রার্থনা=শস্য
অতএব, প্রার্থনা=শূন্য। অর্থাৎ প্রার্থনায় কিছু যায় আসে না।

ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। বিদ্যাসাগর শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নরমাল স্কুল’এর প্রধান শিক্ষক করে নিয়ে আসেন বন্ধু অক্ষয়কে। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।

পাঁচ
নারী শিক্ষার পক্ষে একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন অক্ষয় দত্ত। বিদ্যাসাগর শাস্ত্র না মানলেও যেভাবে শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, তেমনি শাস্ত্র না-মানা অক্ষয়ও নারী শিক্ষার সমর্থনে হিন্দু শাস্ত্র থেকে উদাহরণ দিয়ে সেগুলোকে নারী শিক্ষার সমর্থক বলে ব্যাখ্যা করেতেন।
বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। আমাদের ভাষা আন্দোলনের শতবর্ষ আগে তিনি অফিস–আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনি প্রথা ভেঙে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। দেড় শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন শুনুন—
‘কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনূকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।’

ছয়.
অক্ষয় দত্ত আর বিদ্যাসাগর জন্মেছিলেন একই বছর, আজ থেকে দুই শ বছর আগে, ১৮২০ সালে। তাদের এই কীর্তিময় বন্ধুত্ব তাদের সমসাময়িক দুজন যুগপ্রবর্তক জার্মান দার্শনিকের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এঁদের একজন তাঁদেরই সমান বয়সী, তাঁর নাম ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। অন্যজন দুই বছরের বড়—নাম কার্ল মার্ক্স।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ: প্রাবন্ধিক
[email protected]