আয়া সোফিয়া এবং তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ

এরদোয়ান
এরদোয়ান

দীর্ঘ ৮৫ বছর পর তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক মুস্তাফা কামালের ১৯৩৪ সালে আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এই বাতিলের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এক নির্বাহী আদেশে আয়া সোফিয়াকে আবার মুসলমানদের প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরদোয়ানের নির্বাহী আদেশ আয়া সোফিয়ার সঙ্গে তুরস্কে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে। ধীরে ধীরে রং হারাচ্ছে রক্ষণশীল রাজনীতি। আগামীর রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক এবং গণমানুষের আস্থা লাভ করতে পারে এমন মজবুত কোনো ইস্যু রক্ষণশীলদের থলিতে নেই।

তুরস্কের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পাটাতন অন্য সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে ভিন্ন। ভারতীয় উপমহাদেশসহ আরব বিশ্বের দেশগুলোর ধর্মভিত্তিক দলগুলো যখন পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দোদুল্যমান, তখন মোটাদাগে তুরস্কের ধর্মভিত্তিক দলগুলো পশ্চিমা গণতন্ত্রকে বহুলাংশে নিজেদের মতো করে রূপান্তর এবং পরিবর্ধন করে শাসনব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছে। সেই সূত্রেই কট্টর রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষমতাসীন একেপি নিজেদের রক্ষণশীল গণতন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করে। কামাল আতাতুর্কের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তুরস্ক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করে, যার বদৌলতে বহুদলীয় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনী প্রথা চালু হয়। বহুদলীয় রাজনীতির সুবিধা নিয়ে অটোম্যান-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম রক্ষণশীলেরা রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচনে আসে এবং জয়লাভ করে। তবে ১৯৫০ থেকে আজ পর্যন্ত রক্ষণশীলদের রাজনৈতিক ইস্যুতে মোটাদাগে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি।

মোটাদাগে তুরস্কের রক্ষণশীল রাজনীতি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত। দ্বিতীয় ভাগ ১৯৭০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত এবং তৃতীয়টি ২০০২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। প্রথম পর্বের রাজনীতির অন্যতম দাবি ছিল আজান আরবিতে ফিরিয়ে নেওয়া এবং কোরআন পাঠের অনুমতি প্রদান। স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে দ্বিতীয় ধাপের রক্ষণশীল রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল, সমাজবাদী চিন্তা এবং হিজাব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন। তৃতীয় ধাপের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল, পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র এবং উদারনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীলতার মীমাংসা করে দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা—বেকারত্ব দূর করে সহাবস্থান নিশ্চিত করা। তবে এই তিন ধাপেরই মুখ্য দাবি ছিল আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর করা।

১৯৫০ সালে আদনান মেন্দেরেসের আমলে আজান আরবিতে ফিরে আসে আবার এবং কোরআন পাঠের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়। স্নায়ুযুদ্ধের শেষদিকে তুরগুত ওজাল পশ্চিমের উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করলে সেনাবাহিনীর অব্যাহত চাপে কাজ করতে পারেননি। এরদোয়ানই প্রথম রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ, যিনি দক্ষতার সঙ্গে ধর্মের সঙ্গে পশ্চিমের উদারনৈতিক অর্থনীতির মিলন ঘটান। কাঠামোগত এবং আদর্শিক এই পরিবর্তনের দরুন ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তুরস্কে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পশ্চিমা বিনিয়োগ হয়। এই বিনিয়োগ একসময়ের ইউরোপের রুগ্‌ণ দেশ তুরস্ককে এখন বিশ্বের ১৯তম বৃহৎ অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করেছে।

একেপি রক্ষণশীলদের প্রায় সব আবেদনকে মিটিয়েছে। হিজাব এবং ধর্মীয় শিক্ষার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠেছে ২০১৩ সালে। এবং সর্বশেষ ১০ জুলাই আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর করার দাবিকেও একেপির পক্ষ থেকে সুরাহা করা হলো। এক কথায় বলা যায়, আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের মাধ্যমে রক্ষণশীলদের দাবির একটি বিশাল অংশের মীমাংসা হয়ে গেছে। তাই ভবিষ্যতে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর গণমানুষকে কাছে টানার জন্য মজবুত কোনো ইস্যু নেই।

তবে রক্ষণশীলদের দাবিগুলো যখন ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছিল, তখন আতাতুর্কের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও আদর্শের বিরুদ্ধেও রক্ষণশীলদের অবস্থান দুর্বল হচ্ছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জড়িয়ে পড়েন রক্ষণশীলেরা। উদ্ভব হয় রক্ষণশীল বুর্জোয়াদের। যার দরুন একেপি ভেঙে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমেদ দাভুতোগলু এবং সাবেক উপসহকারী প্রধানমন্ত্রী আলী বাবাজান নতুন দল গঠন করেছেন। নতুন এই দুই দল ভোটের মাঠে একেপিকে দুর্বল করে দিয়েছে। আরেক রক্ষণশীল দল সাদেত পার্টিও বহুকাল আগ থেকেই প্রকাশ্য একেপি বিরোধিতায় মগ্ন। গত সাধারণ নির্বাচনে সাদেত পার্টি প্রধান সেক্যুলার সিএইচপির সঙ্গী হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। সময়ের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে ক্ষমতার অংশীদার হতে চায়। মজার বিষয় হলো, নানান সময়ে নানান দলের সঙ্গী হলেও নিজেদের রাজনৈতিক দুরবস্থার জন্য সেক্যুলার দলগুলোকেই দায়ী করে আসছে রক্ষণশীল দলগুলো, উপমহাদেশের রাজনীতিতে যা আমাদের বেশ পরিচিত। এই দলগুলোর গণমানুষের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য কিংবা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মোটাদাগে কোনো অভিযোগ নেই, অভিযোগ শুরু হয় যখনই ক্ষমতা থেকে ছিটকে যায়।

ক্ষমতা আর অর্থের সঙ্গে ধর্মীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ বোঝার জন্য তুরস্কের সাদেত পার্টি একটি ভালো কেস স্টাডি। মিসরের আল নুর পার্টিকেও এই কেস স্টাডির মধ্যে রাখা যেতে পারে। আদর্শিক ভিন্নতার দরুন মিসরের আল নুর পার্টি যেভাবে সিসির স্বৈরাচারী শাসনের জন্য ময়দান প্রস্তুত করেছিল, ঠিক একইভাবে সাদেত পার্টি ফ্যাসিবাদী কামালবাদের সঙ্গে আপস করেছে। সাদেত পার্টির আদর্শিক গুরু নাজিমুদ্দিন এরবাকানের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল কামালবাদ। এমনকি যখন ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী এরবাকানকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তখন আজকের সিএইচপি প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। অতীত ভুলে গিয়ে ক্ষমতার মোহে আদর্শিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও রক্ষণশীল রাজনীতি এবং কামালবাদ একত্র হয়েছে।

দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও হঠাৎ রাজনীতির ময়দান থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ির পাশের পশ্চিম বাংলায়ও পাওয়া যাবে। আর মুসলিম লীগের বিলুপ্তির কথা তো সবার মস্তিষ্কে এখনো তাজা। রাজনীতির মাঠে প্রাসঙ্গিক থাকতেই রক্ষণশীল এবং কামালবাদী পক্ষের সম্মিলিত রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে আয়া সোফিয়াকে ব্যবহার করেছেন এরদোয়ান। সিরিয়া আর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে পশ্চিমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পশ্চিমের আস্থা হারিয়েছেন এরদোয়ান। আবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের রাজনৈতিক জোট গঠনের দরুন ইতিমধ্যেই সংকটে থাকা এরদোয়ানের একেপি ভবিষ্যতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

*রাহুল আনজুম: তুরস্ক প্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক।