খুলনায় চার হত্যাকাণ্ড

গত বৃহস্পতিবার খুলনার ফুলতলা উপজেলার খানজাহান আলী থানাধীন মশিয়ালী গ্রামে যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল এবং চারজনের প্রাণ গেল, তাতে মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে দেশে আইনের শাসন কতটা কার্যকর আছে। আইনের শাসনের পূর্বশর্ত হলো শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন। এর ব্যত্যয় ঘটেছিল বলেই সেখানে চার–চারটি প্রাণ ঝরে গেছে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ জাকারিয়া ও তাঁর দুই ভাইয়ের দৌরাত্ম্যে গ্রামবাসী অতিষ্ঠ ছিলেন। অভিযোগ আছে, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে জবরদখলে সিদ্ধহস্ত তিন ভাই। সেই সঙ্গে সুদের ব্যবসার নামে সাদা কাগজে সই নিয়ে মানুষের ঘরবাড়ি ও জমিজমা হাতিয়ে নিতেন। এলাকার যাঁরাই তাঁদের অপকর্মের প্রতিবাদ করতেন, তাঁদের ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ।

গত বৃহস্পতিবার মুজিবুর রহমান নামের এক গ্রামবাসীকে অস্ত্রসহ পুলিশে ধরিয়ে দেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ জাকারিয়া। গ্রামবাসীর ধারণা, নিরপরাধ এই ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্র করে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী প্রতিকার চাইতে তাঁর বাড়িতে গেলে তিন ভাই নির্বিচারে তাঁদের ওপর গুলি ছোড়েন। এতে তিনজন নিহত ও সাতজন আহত হন। পরে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর পিটুনিতে জাহিদ নামের এক তরুণ মারা যান। গ্রামবাসী তিন ভাইয়ের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ আটটি স্থাপনা ও একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন।

ঘটনার পর থেকে তিন ভাই পলাতক। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এটি অনেকটা রোগী মারা যাওয়ার পর বাড়িতে ডাক্তার আসার মতো ঘটনা। খুলনা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, ওই তিন ভাই খুবই খারাপ লোক এবং  দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় নানা রকম অপকর্ম করে আসছিলেন। তাঁরা যদি খারাপই হবেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তঁাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না কেন?

এটা অনেকটাই পরিষ্কার যে রাজনৈতিক পরিচয়ের সুবাদে শেখ জাকারিয়া ও তঁার ভাইয়েরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে অপকর্ম করে গেলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। শুরুতেই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হয়তো চারজন মানুষকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। রাজনৈতিক পদপদবি পেয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠা এমন লোকজন দেশজুড়েই ছড়িয়ে আছে। এটা কেবল খুলনার ফুলতলার বিষয় নয়। প্রভাব–প্রতিপত্তি বিস্তার, দখল বা চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ—এসব নিয়ে সরকারি দলের লোকজন নিজেদের মধ্যেও বিরোধ, সংঘাত ও খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। কয়েক দিন আগে কুমিল্লায় যুবলীগের এক কর্মীকে মসজিদ থেকে বের করে এনে হত্যা করা হয়। সেখানেও জমিজমার বিরোধের কারণে স্থানীয় কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা এটি ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

শেখ জাকারিয়া খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটে থাকে, এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। ঘটনার পর তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদকও স্বীকার করেছেন, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে ওই তিন ভাইয়ের বিরোধ ছিল। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট জাফরিন শেখ ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। তিনি হত্যা মামলার আসামি এবং বর্তমানে জামিনে আছেন। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর ছাত্রলীগ তাঁকে বহিষ্কার করে ‘সাংগঠনিক দায়িত্ব’ পালন করেছিল। এ ধরনের লোকজনকে পদপদবি দিয়ে লালন-পালন করা এবং পরিণতিতে এমন হত্যাকাণ্ডের দায়দায়িত্ব তাই সরকারি দলকে নিতে হবে। আর দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আগেভাগে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারার দায় নিতে হবে পুলিশকে।

তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়েছে। দেশের আইনের শাসন কার্যকর আছে—এটা নিশ্চিত করতে হলে তঁাদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।