সাংসদের অপকর্ম ও রাষ্ট্রের দায়

শহিদ ইসলাম
শহিদ ইসলাম

সাংসদ মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের নানা অপকর্ম ও কুয়েতে তাঁর গ্রেপ্তার নিয়ে আমাদের জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আরও কয়েকজন সাংসদের নারীঘটিত কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, দখলদারি ও অন্যান্য গর্হিত আচরণ নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক শিরোনাম হয়েছে। সাংসদ শহিদের বিদেশি নাগরিকত্ব থাকলে তঁার পদ শূন্য করার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যদিও এখন এটি নিশ্চিত যে তিনি কুয়েতের নাগরিক নন। তবে নাগরিকত্ব সমস্যার বাইরেও ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রের আরও অনেক প্রতিষ্ঠানই তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

আমাদের নির্বাচন কমিশনের এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২ ধারা অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনে সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে তাঁদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা আকারে সম্পদের হিসাব দিতে হয়। সম্পদের হিসাবে মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা তথ্য গোপন করলে তাঁর প্রার্থিতা, এমনকি পরবর্তী সময়ে নির্বাচন বাতিল হওয়ার কথা। যেহেতু সাংসদ শহিদ কুয়েতে থাকা তাঁর সম্পদ হলফনামায় গোপন করার কারণে নির্বাচনের দিনে অযোগ্য ছিলেন, তিনি সাংসদ হিসেবে থাকারও অযোগ্য হয়ে পড়েছেন। তাই নির্বাচন কমিশনই তার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ব্যবহার করে, তদন্ত সাপেক্ষে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে, সাংসদ শহিদের সংসদ সদস্য পদ বাতিলের উদ্যোগ নিতে পারে।

এ ছাড়া যেসব সাংসদ দুর্নীতি ও অপকর্মে লিপ্ত হয়ে মহান জাতীয় সংসদ ও এর সদস্যদের মর্যাদাহানি করেন—যাকে সংসদ অবমাননা বলা হয়—তঁাদের বিরুদ্ধে সংসদ নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারে। 

আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ এরেসকাইন মের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘সংসদের বিশেষ অধিকার হলো কতগুলো স্বতন্ত্র অধিকারের সমষ্টি, যা প্রত্যেক সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে এবং সংসদের উভয় কক্ষই ভোগ করে। এগুলো অন্যান্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভোগ করা অধিকারের চেয়ে অতিরিক্ত অধিকার এবং এগুলো ছাড়া সংসদ ও সাংসদেরা দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। তাই যদিও বিশেষ অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনের অংশ, তবু এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ আইনের আওতা থেকে তাদের অনেকটা রেহাই দেওয়া হয়’ (ট্রিয়েটাইজ অন দ্য ল, প্রিভিলেজেস, প্রসিডিংস অ্যান্ড ইউসেজ অব পার্লামেন্ট, ২৩ সংস্করণ)। আমাদের সংসদের উচ্চকক্ষ নেই, তাই উচ্চকক্ষের কথা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এসব স্বতন্ত্র অধিকারকে দুই ভাগে বিভাজন করা হয়: কতগুলো ব্যক্তি সাংসদের বেলায় প্রযোজ্য, অন্য কতগুলো পুরো সংসদের জন্য প্রযোজ্য।

ব্যক্তি সংসদের বেলায় প্রযোজ্য অধিকারগুলো হলো: (ক) বাক্স্বাধীনতা; (খ) দেওয়ানি মামলায় গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি; (গ) জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি; (ঘ) সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি। এগুলো মূলত দায়মুক্তি–সম্পর্কিত অধিকার এবং এগুলো প্রত্যেক সংসদ সদস্যকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২-১৭৬ ধারায় এসব সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।

পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অধিকার ও ক্ষমতাগুলো হলো: (ক) শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকে, এমনকি সাংসদদের বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার বা সংসদ অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদান এর অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষমতা বলেই দুর্নীতি, অপকর্ম, বিশৃঙ্খলা ও অসদাচরণের দায়ে সাংসদদের সংসদ থেকে বহিষ্কার করা যায়। এটি সংসদের শাস্তি প্রদান–সম্পর্কিত ক্ষমতা। (খ) সংসদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ব্যবস্থাপনা ও কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ক্ষমতা। (গ) সংসদে সাংসদদের উপস্থিতি ও সংসদের কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। (ঘ) তদন্ত করার, সাক্ষী ও রেকর্ডপত্র তলব করার ক্ষমতা। আমাদের জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২০১-২০৩ ধারায় এ–সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। (ঙ) সাক্ষীর শপথ গ্রহণের ক্ষমতা। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২০৪-২০৫ ধারা এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। (চ) মানহানির বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কাগজপত্র প্রকাশ করার ক্ষমতা।

অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সংসদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে বিশেষ অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তিকে সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন বা অবমাননার দায়ে শাস্তি দেওয়ার অধিকারকে ক্ষমতা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সংসদে যেকোনো কিছু বলার জন্য কোনো সাংসদের দায়ী না হওয়ার অধিকারই দায়মুক্তি’ [বিশেষ রেফারেন্স, অনুচ্ছেদ ১৪৩, এআইআর (১৯৬৫) এসসি ৭৪৫]। আর এ ক্ষমতা বলেই সাংসদ শহিদকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা যায়।

সংসদীয় গণতন্ত্রে অসদাচরণের দায়ে সংসদ থেকে সাংসদের বহিষ্কারের ঘটনা নিয়মিত ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবেশী ভারতে টাকার বিনিময়ে লোকসভায় প্রশ্ন উত্থাপন করার অভিযোগে ১৯৫১ সালে এইচ জি মুদগাল নামে লোকসভার এক সদস্যকে বহিষ্কারের পর থেকে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে বহু সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়। ২০০৫ সালে দুর্নীতি ও অন্যান্য অসদাচরণের অভিযোগে একসঙ্গে বিভিন্ন দলের ১১ জন সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়। প্রসঙ্গত, রাজা রাম পাল বনাম স্পিকার মামলায় [(২০০৭) ৩ এসসিসি] ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সুস্পষ্টভাবে রায় দেন যে অসদাচরণের দায়ে সাংসদের বিরুদ্ধে সংসদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। প্রয়াত মাহমুদুল ইসলাম রচিত কনস্টিটিউশনাল ল ইন বাংলাদেশ (দ্বিতীয় সংস্করণ) গ্রন্থেও সংসদের এ ক্ষমতার স্বীকৃতি রয়েছে। বস্তুত এটিকে সংসদের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা বলে মনে করা হয়।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এমনকি গুরুতর দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও গত কয়েক দশকে আমাদের জাতীয় সংসদ কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটির তদন্তের ভিত্তিতে আমাদের জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁকে সংসদ থেকে বহিষ্কারের দাবি উঠলেও, নবম জাতীয় সংসদ তাঁর বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা না নিয়ে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করে। প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও অদ্যাবধি সে আইনও প্রণয়ন করা হয়নি।

এ ছাড়া সাংসদ শহিদ কুয়েতে নৈতিক স্খলনের অভিযোগে দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য শাস্তি পেলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাঁর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করা যাবে। তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগেও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও এ ক্ষেত্রে করণীয় রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদ ইচ্ছা করলে শহিদের, এমনকি আরও অনেকের বিরুদ্ধে হলফনামায় তথ্য গোপন, দুর্নীতি ও অনৈতিক আচরণের দায়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রশ্ন হলো এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হবে কি না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)