ট্রাম্পের নির্বাচনী কৌশল ও চীনবিরোধিতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি।

যুক্তরাষ্ট্র চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারির কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে এবং অচিরেই সেই সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা। ১৫ জুলাই এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর রিপাবলিকান পার্টির পছন্দের টিভি চ্যানেল ফক্স নিউজের বিল হ্যামারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও নিশ্চিত করেন যে বিষয়টি তাঁরা বিবেচনা করছেন। সঠিকভাবে এ রকম কিছু করা যায় কি না, তা চিন্তা করা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস এরপর এক নিবন্ধে প্রশ্ন করে, যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে পার্টির ৯ কোটি ৩০ লাখ সদস্যের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে?

প্রশ্নটি একেবারেই ফেলনা নয়। প্রতি ১৫ জন চীনা নাগরিকের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনাই বলে দেয় উত্তেজনা এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যকার এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে চীনের বৈশ্বিক মঞ্চে নেতৃত্ব গ্রহণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা যে প্রতিফলিত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর পুনর্নির্বাচনের ক্ষুদ্র স্বার্থেই চীনকে এই সুযোগ করে দিচ্ছেন কি না? চীনবিরোধী বক্তব্য, বিশেষত বাণিজ্য–সুবিধার বিষয়টিতে প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটদের ওপর দায় চাপানোর সুবিধা নিতেই নভেম্বর যত ঘনিয়ে আসছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চীনবিরোধী উত্তাপ ততই বাড়ছে।

চীনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বছরগুলোর বাণিজ্যবিরোধের পর সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক বিতর্কে একের পর এক যেসব বিষয় যুক্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও নিরাপত্তাজনিত কৌশলের বিপরীতে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী অবস্থান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের তথ্য গোপনের অভিযোগ, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের উদ্ভাবন চুরি ও প্রতিযোগিতায় অন্যায় সুবিধা গ্রহণ, সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমানদের জাতিগত নিপীড়ন এবং হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ। গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে সংবাদমাধ্যমও এই বিরোধের কোপে পড়ে। চীন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর তিনজন সাংবাদিককে বহিষ্কার করে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সিনহুয়া, চায়না গ্লোবাল টিভি নেটওয়ার্ক এবং চায়না ইন্টারন্যাশনাল রেডিওর কার্যক্রমকে সীমিত করার লক্ষ্যে সেগুলোকে দূতাবাসের অংশ ঘোষণা এবং কর্মী সংখ্যা কমাতে বাধ্য করে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ট্রাম্প প্রশাসনের এই ভূমিকা নিয়ে খুব একটা আলোচনা এবং বিরোধিতা নেই। কিন্তু তার জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে ভূরাজনৈতিক বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের চীনবিরোধী তৎপরতা থেমে নেই। বরং তা অনেকটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি লাদাখে সৃষ্ট চীনের সঙ্গে ভারতের সামরিক উত্তেজনায় ট্রাম্প প্রশাসন খোলাখুলিভাবেই ভারতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্র দুটো যুদ্ধবিমানবাহী রণতরি পাঠিয়েছে। ‘নিমিৎস’ ও ‘রিগ্যান’ নামে দুই বণতরির সেখানে এই প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ১৭ জুলাই নিমিৎসের অধিনায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল জিম কার্ক বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখার বিষয়ে আঞ্চলিক মিত্রদের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন হিসেবে দক্ষিণ চীন সাগরে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আমাদের তৎপরতা চলছে। দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপমালার অধিকার নিয়ে চীনের সঙ্গে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিরোধ সাম্প্রতিক কালে তীব্র হয়েছে। ওই অঞ্চলে চীন সামরিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করার পর এই বিরোধ বেড়েছে।

ফক্স নিউজের ওই অনুষ্ঠানে পম্পেও বলেন, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে। তিনি চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপগুলোর ফিরিস্তি তুলে ধরে বলেন, ৪০ বছর ধরে আমরা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম এবং চীন আমাদের পদদলিত করার সুযোগ পেয়ে এসেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, আর নয়, এখন থেকে ন্যায়ভিত্তিক ও পরিপূরক বাণিজ্য সম্পর্ক হতে হবে। তিনি উহানে কোভিড–১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এটি যখন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল, তখন তারা তথ্য গোপন করায় বিশ্বকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। হাজার হাজার কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে এবং লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে এর জবাবদিহি করানোর জন্য বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ হবে বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।

এর এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দাবি করেন যে তাঁর অনুরোধেই যুক্তরাজ্য হুয়াওয়ের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। ১৪ জুলাই নিরাপত্তা–ঝুঁকির কারণে যুক্তরাজ্য মোবাইল ফোনের ফাইভ–জি প্রযুক্তি সরবরাহের বিষয়ে হুয়াওয়ের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি বাতিল করে। তবে এর জন্য যুক্তরাজ্যকে খেসারত দিতে হবে অনেক। দেশটির মোবাইল টেলিফোন অবকাঠামো হুয়াওয়ের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে তা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাহারের জন্য তাদের প্রয়োজন হবে সাত বছর। এতে ফাইভ–জি সংযোগ চালু করায় বিলম্ব তো ঘটবেই, উপরন্তু ফোর–জি প্রযুক্তির সংযোগও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তা ছাড়া চীন হুয়াওয়ের এই চুক্তি বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বিশেষ করে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চীনকে শায়েস্তা করার বিষয়টি এমন সময়ে ঘটছে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতায় থাকা না-থাকার বিষয়টি নির্ধারণ হতে আর ১০০ দিনও বাকি নেই। সাম্প্রতিক সব জনমত জরিপে তিনি তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে অন্তত ১০ পয়েন্টে পিছিয়ে আছেন। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এই ব্যবধান আরও বাড়বে বৈ কমবে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে মহামারিতে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো নাগরিকের মৃত্যু এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে অর্থনীতির নিম্নমুখী যাত্রা। তিন মাস ধরে ভাইরাস সংক্রমণের জন্য চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে দায়ী করে তিনি তাঁর প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আড়াল করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। তাঁর সমর্থকেরা অনেকেই সেটা গ্রহণও করেছেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করায় হাওয়া ঘুরতে শুরু করছে। জাতীয়ভিত্তিক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশটির দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ এখন মনে করছে ট্রাম্প পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এত দিন ধরে জোরালো অর্থনীতি গড়ে তোলার কৃতিত্ব দাবি করে আসার পর হঠাৎ করেই এখন যে মন্দার হাওয়া বইতে শুরু করেছে, ভোটে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। মধ্য জুনেই দেশটির মোট শ্রমশক্তির চার ভাগের এক ভাগ কাজ হারিয়ে বেকার ভাতার আবেদন করেছে। বেকারত্বের হার বাড়ার চেয়েও তাঁর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি না হওয়া। এই অর্থনৈতিক দুর্ভোগের জন্য চীনের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের, বিশেষ করে কৃষিপণ্যের অসম প্রতিযোগিতার ধুয়া তোলা তাঁর জন্য কিছুটা সহায়ক হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

১৮৭০ সাল থেকে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনগুলোর বিষয়ে গবেষণা করেছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গুয়োতাই জুনান সিকিউরিটিজ বলছে যে এখন নির্বাচন হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আবারও নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ৩০ শতাংশ। কিন্তু তিনি যদি চীনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে পারেন অথবা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে। গত জুন মাসে প্রকাশিত তাদের সমীক্ষা বলছে, সে রকম ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পাবেন। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণাপ্রধান হুয়া চাংচুন বলেছেন, ট্রাম্প চরম পদক্ষেপ গ্রহণের পথে যেতে পারেন। তাঁর মতে, এর উদ্দেশ্য হবে একটি বাণিজ্য সমঝোতায় পৌঁছানো। সম্ভবত এই কৌশলের অংশ হিসেবেই তিনি বলতে শুরু করেছেন চীন তাঁকে হারাতে চায়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ প্রয়োগের পরও যদি কোনো বাণিজ্য চুক্তি না হয়, তাহলে তাঁর অন্তত একটা জাতীয়তাবাদী ব্যাখ্যা তৈরি থাকবে।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক