গ্রামীণ অর্থনীতিকে বাড়তি চাপ নিতে হবে

>
ড. সায়মা হক বিদিশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। শ্রম অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শ্রমবাজার, দারিদ্র্য, খাদ্যনিরাপত্তা, জেন্ডার ও নারীর ক্ষমতায়ন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও তরুণ জনগোষ্ঠী, অভিবাসন ও রেমিট্যান্স আয়, শিক্ষা ও দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে আসছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন করোনাকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের কাজ হারানো, গ্রামে ফিরে যাওয়া ও শ্রমবাজার পরিস্থিতি নিয়ে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন

প্রথম আলো: বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতির কারণে ১৩ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কোন খাতগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে?

সায়মা হক: আমরা নিজেরাও গবেষণা করে দেখেছি যে মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং হারাচ্ছেন। অর্থাৎ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এখন ১৩ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেটা বাড়তেও পারে। আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতের। আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, টেইলার্স ইত্যাদির কর্মচারী, নির্মাণ খাত ও কৃষি খাতের শ্রমিক এবং গৃহকর্মীরা বড় ধরনের আয় হারিয়েছেন; অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।

প্রথম আলো: এভাবে দরিদ্র হয়ে পড়া মানুষকে শনাক্ত করা ও সহায়তার পথ কী?

সায়মা হক: তাঁদের জন্য কিছু করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের শনাক্ত করে তালিকা তৈরি করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজটি কঠিন হবে। ফলে কাজ হারানো লোকজন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে যাতে তালিকাভুক্ত হতে পারেন, সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর জন্য হটলাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সরকারের আইসিটি বিভাগ এ ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। তথ্য যাচাইয়ের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এ কাজে বিভিন্ন খাতের সংগঠন যেমন দোকান মালিক সমিতি ও শ্রমিক সমিতিগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া এসব মানুষ নিয়ে কাজ করে, এমন এনজিওগুলোকে যুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে তৈরি তালিকা হয়তো শতভাগ নির্ভুল হবে না, তবে এভাবেই অনেকটা সঠিক তালিকা করা সম্ভব।

প্রথম আলো: কাজ হারানো মানুষের সামনের দিনগুলোতে কাজ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে কী দেখতে পাচ্ছেন?

সায়মা হক: কর্মসংস্থানের কথা যদি চিন্তা করি, তবে দেখব ব্যক্তি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাঁদের এখন ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে এখানে খুব দ্রুত কিছু হবে না। দেশীয় বাজারে চাহিদার সংকট রয়েছে। কিছু কিছু খাত আছে, যেমন বিউটি পারলার বা রেস্টুরেন্ট, যেগুলো খুব অত্যাবশ্যকীয় নয় কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে এ ধরনের ক্ষুদ্র সেবার চাহিদা রয়েছে; এসব খাতে প্রচুর নিম্ন আয়ের মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাঁদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এসবের চাহিদা তৈরি হবে না। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করলে রপ্তানি বাণিজ্যে ধস নামবে। তখন শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। অর্ডার না এলে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবেন। নতুন বা ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ নিতে এবং বিনিয়োগ করতে যে স্বাভাবিক আস্থার পরিস্থিতি প্রয়োজন, তা এখন নেই। ফলে খুব দ্রুত পরিস্থিতির বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

প্রথম আলো: কোভিড–১৯ মহামারি সামগ্রিকভাবে দেশের কর্মসংস্থানের ওপর কতটুকু গভীর প্রভাব ফেলবে?

সায়মা হক: দেখুন, কোভিড–১৯–এর কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান বাড়িতে বসে কাজ চালু করেছে। দেখা যাচ্ছে পাঁচজনের কাজ তিনজনকে দিয়ে করানো হচ্ছে। ফলে দুজনের চাকরি ভবিষ্যতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনার প্রভাবে শ্রমঘন শিল্পগুলো অটোমেশনের দিকে ঝুঁকবে। সেটা কর্মসংস্থানের ওপর চাপ ফেলবে। কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার আগে থেকেই বাড়ছিল, কোভিড–১৯ মহামারি এটাকে দ্রুততর করবে। তাই শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দক্ষতার যে সমন্বয়হীনতা (স্কিল মিস–ম্যাচ) রয়েছে, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

প্রথম আলো: কাজ হারিয়ে মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে?

সায়মা হক: ঢাকা ও অন্যান্য শহরে যাঁরা কাজ হারিয়েছেন, তঁারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন কারণ এতে তাঁদের বাড়িভাড়া বেঁচে যাবে, ডাল-ভাতেরও ব্যবস্থা সেখানে করা যাবে। তা ছাড়া গ্রামে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। এসব মিলিয়ে গ্রামই এসব মানুষের কাছে শ্রেয় বিকল্প মনে হচ্ছে। গ্রামে ফিরে কেউ কেউ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবেন। এতে কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাবে, ফলে মজুরি কমে যেতে পারে। গ্রামের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সামনে সেটা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল কাজ কমে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ পড়তে পারে।

প্রথম আলো: সামাজিক প্রভাব?

সায়মা হক: শিক্ষার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে মনে হয়। যাঁরা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তঁাদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই শহরের বিভিন্ন স্কুলে পড়ত। গ্রামে ফিরে গেলে একই মানের স্কুল মিলবে না। তাদের শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্কুল থেকে ঝরে পড়া বাড়বে, মেয়েদের ক্ষেত্রে তা বেশি হবে। বাল্যবিবাহ বেড়ে যেতে পারে। তরুণ বয়সের যেসব ছেলেমেয়ে গ্রামে ফিরবেন, তঁারাও একধরনের সামাজিক সংকট ও অনিশ্চয়তায় মধ্যে পড়বেন। তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে।

প্রথম আলো: আপনি বলেছেন গ্রামে ফেরা মানুষ গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করবে। মানুষের গ্রামে ফেরার কি কোনো ইতিবাচক দিক নেই?

সায়মা হক: মানুষ এখন বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরছেন। আমরা যদি গ্রামকে এমন করতে পারি যাতে মানুষ গ্রামকে ভালো বিকল্প মনে করেন, তবে সেটা হবে কাজের কাজ। সে জন্য গ্রামের শিক্ষা, অবকাঠামো ও বিনোদনসহ নানা সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে হবে। জেলাগুলোকে ভিত্তি করে যদি গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, তবে অনেকেই গ্রামে থাকতে আগ্রহী হবেন। বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে হয়তো সরাসরি প্রচলিত কৃষিকাজে যুক্ত হতে চাইবেন না। সে ক্ষেত্রে কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিপণন, সরবরাহ এবং প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রামীণ বিনিয়োগ ও ঋণ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো: অনেক প্রবাসী শ্রমিক ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তঁাদের একটি বড় অংশ হয়তো আর সেসব দেশে কাজে ফিরতে পারবেন না। তঁাদের একটি বড় অংশও তো গ্রামে ফিরবে।

সায়মা হক: প্রবাসীদের অনেকে ফিরে এসেছেন, অনেকে তাঁদের সঞ্চয় দেশে পাঠানো শুরু করেছেন। তাঁরাও হয়তো সবকিছু গুটিয়ে চলে আসবেন। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেছে, আসছে বিশ্বমন্দা। এটা আমাদের প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যাঁরা গ্রামে ফিরে কৃষিকাজে যুক্ত হতে চাইবেন না, তাঁদের জন্য সরকার খুবই স্বল্পস ুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে, যাতে তাঁরা নিজেদের জমানো টাকা ও ঋণের টাকা মিলিয়ে খামার বা এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন।

প্রথম আলো: বিপুল জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া, কাজ হারানো এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলো কার্যকর করার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

সায়মা হক: সরকার ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের শিল্পের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২০ হাজার কোটি টাকা রেখেছে। যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা যেন এটা সহজে পেতে পারেন তা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। প্রণোদনা পেতে হবে খুবই সহজ শর্তে এবং একেবারে কম সুদে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এটা খুবই জরুরি। শিথিল শর্তের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যদি কিছু ক্ষেত্রে ঋণ শোধ করতে না–ও পারেন, তবে তা এ পরিস্থিতিতে খুব বড় সমস্যা বলে আমি মনে করি না। এ কাজে মূল ব্যাংক খাতের বাইরের বিভিন্ন খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। কারণ, ব্যাংক খাত এ অর্থ ব্যবস্থাপনাকে লাভজনক মনে না–ও করতে পারে। আরও অনেক সৃজনশীল পদক্ষেপ নেওয়া যায়। যেমন শপিং মলের দোকানভাড়া বা বিদ্যুৎ বিল কমানো যেতে পারে, বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে শুল্ক ও কর ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কমবে। তরুণদের জন্য স্টার্টআপ পুঁজির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রথম আলো: দরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও সব ধরনের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা ও ঋণসহায়তার কথা বলা হচ্ছে। এত কিছু করার সামর্থ্য কি সরকারের আছে?

সায়মা হক: স্বাস্থ্যসুবিধা, খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান—এসবই এখনকার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এর জন্য অর্থ লাগবে; কোথা থেকে তা আসবে? একেবারেই কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো আপাতত বন্ধ রাখা যায়। সরকারের পরিচালন ব্যয় ও এডিপিতে বড় ধরনের কাটছাঁট করে অর্থ বের করা সম্ভব। সরকারি কর্মচারীদের নানা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও বোনাস কমানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মূল্যায়ন করে বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সরকার সব পারবে না। সে জন্য এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও দাতা সংস্থার সহায়তা নিতে হবে।

প্রথম আলো: কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মহীনদের সহায়তা, সামগ্রিক অর্থনীতি সামাল দেওয়া, এনজিও, দাতাগোষ্ঠীকে যুক্ত করা—এসব সমন্বয়ের কাজটি কীভাবে করা উচিত?

সায়মা হক: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ব্যক্তি খাত, এনজিও, গবেষক এবং নাগরিক সমাজকে এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করলে ভালো হয়। এটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি। প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করার উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সায়মা হক: ধন্যবাদ।