কমিটি গঠন নয়, ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি

কোভিড-১৯ মহামারি যুক্তরাষ্ট্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করান। চীনকে দোষারোপের কিছুটা যুক্তি থাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে গালিগালাজের মধ্যে ব্যর্থ লোকের ব্যক্তিগত আক্রোশের প্রকাশ ঘটে। ট্রাম্প বলতে থাকেন: আমারটা খাও আর আমার মানুষগুলোকে বাঁচাতে পারো না! তোমার ব্যর্থতার কারণে করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং শয়ে শয়ে মরছে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি যে ওটি ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’, ‘বিশ্ব মৃত্যু প্রতিরোধ সংস্থা’ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ প্রদান সবচেয়ে বেশি, চীনের অনেক কম। এটা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অর্থ বেশি দিই, আর সংস্থাটি কাজ করে চীনের পক্ষে। আমরা সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসব।’ শুধু মুখে হুংকার দেননি, বেরিয়ে আসার আয়োজনও করতে থাকেন। শক্তিমানের কাণ্ডজ্ঞানহীন সমালোচনার ভদ্রোচিত প্রতিবাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্বাহীও করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মচারী নন। তা ছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষ যত দুর্বলই হোক, একতরফা গালাগাল সহ্য করে না। সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস ১৪ জুলাই বলেছেন, কোভিড মোকাবিলায় অধিকাংশ দেশের সরকার ভুল পথে হাঁটছে। এক দিন পর জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, কোভিড বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হওয়ার জন্য বিশ্বনেতাদের অবহেলা কম দায়ী নয়; তাঁরা যথাসময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। এই মহামারি তাঁদের জন্য এক পরীক্ষা। ‘অধিকাংশ দেশ’ বললেও তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।

পৃথিবীতে ‘বিশ্বনেতা’ বলে কোনো পদ নেই। এই শব্দের সর্বস্বীকৃত সংজ্ঞাও নেই। তবে ধারণা করি, যেসব দেশ সমরাস্ত্র উৎপাদনে, বিপণনে ও ব্যবহারে অগ্রগামী এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, সেসব দেশের নেতারা বিশ্বনেতা অভিধা পেয়ে থাকেন। তা ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্র, যারা ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এবং তাদের সহযোগী দেশের রাষ্ট্রনায়কেরাই ‘বিশ্বনেতা’। প্রথম পর্যায়ে কোভিডে বিপর্যস্ত হয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি প্রভৃতি দেশ। তাদের থেকে ছড়িয়েছে অন্যান্য দেশে। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছে ইতালি থেকে। সেই ইতালি এখন একটুখানি উঠে দাঁড়িয়ে চোটপাট করছে বাংলাদেশের সঙ্গে।

কোভিড নিয়ে পরাশক্তিগুলো হিমশিম খেলেও বাংলাদেশ কোনো বিপর্যয়েও ঘাবড়ে যাওয়ার দেশ নয়। এক প্রতিবেশী দেশ তার ১০ লাখ নাগরিককে পিটিয়ে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিল, আমরা প্রতিহত করতে পারিনি। তার প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ঠুকল অন্য দেশ, আমরা নই। কোভিড ঠেকাতে আমরা আমাদের প্রথাগত পদ্ধতি প্রয়োগ করি, যা জনগণকে প্রবোধ দিতে সবচেয়ে মোক্ষম পথ: কমিটি গঠন।

আমাদের শাসনব্যবস্থার একটা বৈশিষ্ট্য হলো যেকোনো ব্যাপারে অবিলম্বে কিছু কমিটি গঠন করা। ট্রেন দুর্ঘটনা হোক, লঞ্চ দুর্ঘটনা হোক, বিমান দুর্ঘটনা হোক, অগ্নিকাণ্ড হোক—কমিটি গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব সম্পন্ন করে থাকি। কোভিড মোকাবিলা করতেও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।

এর প্রাদুর্ভাবের পর একটির পর একটি কমিটি গঠিত হতে থাকে। সাকল্যে ৪৩টি কমিটি গঠনের কথা সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গিয়েছিল। এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ৪৩টি নয়, মাত্র ১১টি।

বর্ষায় বাংলাদেশের খরস্রোতা নদীগুলোরই যে শুধু একূল-ওকূল ভাঙে তা নয়, কমিটিগুলোতেও ‘ভাঙা-গড়ার কাজ’ ঘটে থাকে। ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো কমিটি করলে দেখা যাচ্ছে সমান্তরাল কমিটি হচ্ছে মন্ত্রণালয়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠন করে আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। কিছুদিন পর মন্ত্রণালয় গঠন করে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। অধিদপ্তরের সংবাদ ব্রিফিংয়ের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের দুই কর্মকর্তাও সাংবাদিকদের ডেকে কথা বলতে শুরু করেন। এ পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা সচিবালয়ে নিজের কক্ষ ফেলে রেখে মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভবনের একটি কক্ষে বসতে শুরু করেন।’ [প্রথম আলো, ১৮ জুলাই]

সচিবালয়ের ভবন বহুদিনের পুরোনো। পুরোনো ঘরে বসার চেয়ে নতুন ভবনের আধুনিক আসবাবে সুসজ্জিত কক্ষে বসার আনন্দ অন্য রকম। তা ছাড়া সাংবাদিকদের ডেকে ব্রিফ করার সুযোগ একুশ শতকে কেউ হাতছাড়া করবেন—অত বোকা মানুষ এ যুগে নেই। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আটটি কমিটির কোনো সভাই হয়নি।’ এক কমিটির সঙ্গে আরেক কমিটির সমন্বয় নেই।

কমিটির পর কমিটি হয়েছে, কিন্তু যে কমিটির দায়িত্ব ও ক্ষমতা বিপুল, সেই স্বাস্থ্যবিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির ভূমিকা সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ত্রুটিবিচ্যুতি, দুর্নীতি-দুর্বলতা তো তারাই ধরবে। মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের কাছে তারাই চাইবে জবাবদিহি।

কোভিড মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে যেসব অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটছে, তাতে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চাপা আতঙ্ক। অধিকাংশ কর্মকর্তা অসাধু নন। রাজনৈতিক মদদে যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাতে সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন। প্রশিক্ষিত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মনোবল নষ্ট হলে তাঁরা কোনো কাজই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করবেন না। কোনোরকমে মাসটা পেরোলে যদি বেতন-ভাতা পাওয়া যায়, কে হতে চাইবেন বলির পাঁঠা? যে কর্মকর্তা কোনো প্রকল্পের একটি টাকাও তাঁর পকেটস্থ করেননি, তাঁর দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে খেয়ে সাবাড় করার দায় পদাধিকারবলে বহন করার মধ্যে যে বেদনা, তা খুন হওয়ার শামিল।

আগের দিনে বাল্যশিক্ষায় পড়ানো হতো: ‘মানীর অপমান বজ্রাঘাততুল্য’। যে কর্মকর্তা কোনো অপরাধ করেননি, তাঁকে যদি ঘটনাচক্রে অপবাদে পড়তে হয়, তাহলে তাঁর মরে গিয়েও বাঁচার উপায় থাকে না। পরিবার-পরিজন ও বংশধরেরাও তাঁর অপবাদের গ্লানি ভোগ করতে থাকবেন। বিয়ে-শাদির সময় লোকে বলবে: বরের/কনের দাদা/নানা ছিল ঘুষখোর।

এক-এগারোর পর এমন অনেক নেতা ও কর্মকর্তাকে দুর্নীতিতে জড়ানো হয়েছিল, যা ছিল রাষ্ট্রের দিক থেকে ঘোরতর অপরাধ। কেউ কেউ জেল পর্যন্ত খেটেছেন। কাউকে অপমান করার প্রতিভা বাঙালির সীমাহীন। ব্যক্তিস্বার্থে আঘাত লাগামাত্র বাঙালি প্রত্যাঘাত করে। আঘাত করার জন্য তার লাঠি-ছুরির দরকার হয় না, মুখই যথেষ্ট। ভুয়া বিলে কোনো সৎ কর্মকর্তা স্বাক্ষর না করলে বলা হবে: ‘হের বাপে ছিল রাজাকার; প্রতিদিন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে দই আর চমচম সাপ্লাই দিত।’ কার বাপের সাধ্য এই অভিযোগ খণ্ডন করে। অবশ্য কষ্ট করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই কর্মকর্তার জন্মদাতা হয়তো একাত্তরের ২৫ মার্চের দুই সপ্তাহ আগেই বেহেশতবাসী হয়েছিলেন। যে সমাজে মিথ্যাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তার অধঃপতন রোধ করার সাধ্য বিধাতারও নেই।

সব দোষ সরকারকে দেওয়া যাবে না। আমরা একটা অদ্ভুত ব্যবস্থার ভেতরে আটকা পড়েছি। পত্রিকার প্রথম পাতায় ও টিভি চ্যানেলের সংবাদ শিরোনামে সব নষ্ট-ভ্রষ্ট-দুশ্চরিত্র মানুষ। পাঠক-দর্শক তা উপভোগও করে। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কোমলমতি কিশোর-কিশোরীদের পর্যন্ত ধারণা হচ্ছে, দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষই ওই শ্রেণিভুক্ত।

ছয় মাস পার হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি প্রলম্বিত হবে বলেই ধারণা হচ্ছে। কোন দেশ কী ভুল পথে চলেছে, তা তাদের ব্যাপার। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের গোয়ালে নিজেদেরই ধোঁয়া দিতে হবে। গত ছয় মাসে কী কী ভুল হয়েছে, তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কাগুজে কমিটির ওপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে কোভিডে কত প্রাণহানি হলো, তার চেয়ে বড় বিষয় এই ব্যামো জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে অসুস্থ করে ফেলবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক