স্বাস্থ্য খাতে জবাবদিহি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল কালাম আজাদ মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র পেশ করার পর বৃহস্পতিবার খবর বেরিয়েছে, সরকার ওই অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল হাসানকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই দিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে নতুন মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এগুলো যে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তীব্র গণসমালোচনার প্রতিক্রিয়া, তা সাধারণ দৃষ্টিতেই বোধগম্য। তবে এসব পদক্ষেপের ফলে আসল সমস্যার কতটুকু সমাধান হবে, এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিছু দুর্নীতির খবর ছিল রীতিমতো কেলেঙ্কারি। কোভিড-১৯ মহামারি আসার পর তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দায়িত্বহীনতার কিছু নমুনা এককথায় বিস্ময়কর। যেমন রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠানকে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়ে, ‘সরল বিশ্বাসে’। তারা করোনার নমুনা পরীক্ষা না করেই হাজার হাজার মানুষকে পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে এবং তার ফলে দেশের ভেতরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার বিশ্বাসযোগ্যতা ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। শুধু ওই দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন না করে, তাদের প্রস্তুতি ও সক্ষমতার বিষয়ে কোনো খোঁজখবর না নিয়েই। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এখানে শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘সরল বিশ্বাস’ কাজ করেছে, নাকি অনৈতিক যোগসাজশও ছিল? মানুষের মনে এমন সাধারণ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সচেতন সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এত ব্যাপক মাত্রায় অনিয়ম-দুর্নীতি সম্ভব নয়।

করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্যসেবা খাতের ভেঙে পড়ার একটা ফল হলো এই যে চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ভীষণভাবে কমে গেছে। করোনা হাসপাতালগুলোর ৭২ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে, মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছে না। শুধু সাধারণ মানুষের করোনা চিকিৎসা নয়, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের করোনা চিকিৎসার মান নিয়েও গুরুতর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৭০ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মী মিলিয়ে তিন হাজারের বেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন—এটা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার স্বাভাবিক ব্যর্থতা নয়। করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জাম, বিশেষত এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই কেনা ও সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির ফল। এসব ছাড়া চিকিৎসকদের খাবার কেনার খরচ, ভার্চ্যুয়াল সভার খরচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেসব পুকুরচুরির খবর বেরিয়েছে, তা–ও বিস্ময়কর। সব মিলিয়ে এ করোনাকালে প্রতিভাত হচ্ছে আমাদের সরকারি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি সিস্টেমেটিক বা পদ্ধতিগতভাবে স্থায়ী চর্চায় পরিণত হয়েছে; দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনা এ খাতের সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে।

এটা হতে পেরেছে জবাবদিহির ব্যবস্থার অভাবে। সমাজে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে কর্মকর্তাদের পদত্যাগ কিংবা এক পদ থেকে অন্য পদে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে জবাবদিহি ঘটে না। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো তদন্ত করে আইনানুগ শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত জরুরি। সে জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা প্রয়োজন।