কীভাবে শিক্ষায় ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব

বাংলাদেশের জনসংখ্যায় তরুণ বয়সীদের অনুপাত বেশি। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দ্বারা তাদের দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব। তা ছাড়া শিক্ষিত যুবসমাজ হবে সমাজের আলোকিত অংশ। কাজেই চলমান করোনা মহামারিকালে তাদের মূল্যবান সময়ের সদ্ব্যবহারের বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও সঠিক কার্যক্রম প্রয়োজন।

মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চার মাস ধরে বন্ধ রয়েছে; হয়তো আরও দুই–তিন মাস বন্ধ থাকবে। তারপরের পরিস্থিতিও অনিশ্চিত। তাহলে এ বছরের শিক্ষা কার্যক্রমের কী হবে? এমনিতেই আমাদের স্কুল–কলেজে শিক্ষা অর্জনের মান প্রত্যাশার তুলনায় কম। একটি বছরের অর্ধেকটাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি হবে আরও বিপর্যস্ত। সে বিবেচনায় কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। যেমন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য টিভি চ্যানেলে ক্লাস নেওয়া। এসব ক্লাসের অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রশ্নমালা দেওয়া হয়। সেগুলোর উত্তরপত্র তৈরি করলে তা বছর শেষে মূল্যায়নে কাজ লাগবে। এগুলো অবশ্যই ভালো পদক্ষেপ, যদিও পাঠদানের মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।

কিন্তু শুধু এ ব্যবস্থায় বার্ষিক পাঠ্যসূচি শেষ করা ও শিক্ষার্থীদের পক্ষে রপ্ত করা সহজ হবে না। কারণ, প্রায় অর্ধেক স্কুলশিক্ষার্থীর বাড়িতে টিভি, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট নেই। প্রত্যন্ত ও দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে এসব সুবিধা আরও কম। ফলে এ ব্যবস্থায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য আরও প্রকট হবে।

এসব ক্লাসের শেষে দেওয়া প্রশ্নমালার উত্তর তৈরিতে অভিভাবক ও গৃহশিক্ষকের সহায়তা নেওয়া সম্ভব। কাজেই এগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন সঠিক হবে না। আর শিক্ষার্থী এ অনুশীলন সম্পূর্ণ করতে না পারলে সেটা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যাবে না। ফলে তার প্রতিকার
করা যাবে না; শিক্ষকের সেখানে আলাদা মনোযোগ দেওয়ারও সুযোগ ঘটবে না। মোট কথা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সহপাঠী ও শিক্ষকদের সঙ্গে আদান-প্রদানের অভাবে সবাই মানসিক চাপের মধ্যে থাকবে। তা ছাড়া বিশেষত মেয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের গৃহকর্মে অংশগ্রহণের বিষয়টিও থাকবে।

পরিবারের উপার্জন কমার ফলে এ সময়ের আরেকটি অভিঘাতের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিক্ষায়। গত দুই মাসে বেশ কিছু জরিপের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র ও অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর উপার্জন কমেছে বেশ বড় অনুপাতে। এসব পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য গৃহশিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণে যে ব্যয় করা সম্ভব হতো, তার সংকোচন ঘটবে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বার্ষিক পরীক্ষার অনিশ্চয়তা, এসব কারণে পাঠ্যসূচি কাটছাঁট করা উচিত কি না। এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে কিন্তু সর্বশেষ সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। পাঠ্যসূচি কাটছাঁট করার পদক্ষেপ কি ভালো হবে? কিছু বিষয়, যেমন একটি শ্রেণির গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের পাঠ্যসূচি সংক্ষিপ্ত করে পরবর্তী শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অগ্রসর হওয়া শিক্ষার্থীদের পক্ষে কঠিন হবে।

এসব সমস্যা সমাধানে করণীয় কী? শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষা বোর্ড সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে অগ্রসর হতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত কার্যকর করাও কঠিন হবে। সেগুলোর ভালো–মন্দও বোঝা যাবে না। এখানে আমার কিছু প্রস্তাব রাখছি:

টিভি চ্যানেলে যে পাঠদান হয়, তা লিখিত রূপে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা সুবিধামতো সময়ে কপি সংগ্রহ করতে পারে। শিক্ষার্থীরা অনুশীলন প্রশ্নগুলোর উত্তর পরের সপ্তাহের মধ্যে জমা দেবে; শিক্ষকেরা তা মূল্যায়ন করে মন্তব্যসহ ফেরত দেবেন। এসব পাঠদানের মানোন্নয়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

সংক্রমণ শেষে বিদ্যালয় খোলা এবং এক–দুই মাস ক্লাস চলার পর সীমিতভাবে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে (যেমন দুই ঘণ্টার বদলে ১ ঘণ্টা, ১০ বিষয়ের বদলে ৫ বিষয়ে পরীক্ষা)। কিন্তু এসএসসি, এইচএসসি ইত্যাদি সমাপনী পরীক্ষার কী ব্যবস্থা হবে? ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা হতে পারে স্কুল খোলার এক মাসের মধ্যে। ২০২১ সালের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কারণ পাঠ্যসূচি তো শেষ করতে হবে।

এ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীর ও শিক্ষার মানের কিছু ক্ষতি হচ্ছে বটে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে নতুন কিছু সম্ভাবনা সৃষ্টি করা সম্ভব। যেমন টিভি চ্যানেলে একই পাঠদান সব শিক্ষার্থী পাচ্ছে—এটি বিদ্যালয় খোলার পরও চালু রাখা যেতে পারে। এভাবে প্রকৃত সৃজনশীল, উদ্ভাবনী ও চিন্তা বিকাশের উপযোগী শিক্ষার পথ খুলে দেওয়া যায়। তা ছাড়া এখনই দূর সংযোগের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আলোচনার কিছু ধারা প্রচলন করা যায়। এত দীর্ঘ বন্ধের মধ্যে শিক্ষকেরাও নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে আগ্রহী হবেন। তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে এসেছেন, এমন উদাহরণও দেখা যাচ্ছে। দরিদ্র ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার জন্য নীতিনির্ধারকদের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ও পরবর্তী মূল্যায়ন ব্যবস্থা নিয়েও এখন থেকেই ভাবতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো অনলাইন পাঠ্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধক আছে। যেমন সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নিজস্ব ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার নেই; অনেক অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য নয়, সার্বক্ষণিক নয়, গতি কম, ইত্যাদি। কিন্তু আগেই এসব সমস্যা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া যেত। তবে এখনই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। সংক্রমণ আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও যেন অনলাইন পাঠদান চালু করা যায়। এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকেরাও এ বিষয়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে তৎপর হবেন। এ রকম পাঠদানের ক্ষেত্রে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। সে জন্য সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আগেভাগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাদান পদ্ধতির জন্য অবকাঠামো প্রস্তুত ও প্রসারিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা বৃদ্ধি চালু রাখতে হবে। স্বাভাবিক সময়েও প্রতিটি বিভাগে কিছু কোর্স বা কোর্সের অংশবিশেষ অনলাইনে চালানোর কার্যক্রম রাখাটা হবে প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজ গড়ার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ।

মহামারি দূর হোক, এটাই সবার প্রত্যাশা। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনো আবারও দুর্যোগ এলে তা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার রণকৌশল রপ্ত করা হবে উচ্চশিক্ষার অংশ। চলমান মহামারির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানো গেলে এ দুর্যোগ থেকে কিছু সম্ভাবনার দ্বারও খুলে যেতে পারে। শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার প্রসারের মাধ্যমে শিক্ষার মান উন্নত হবে, পাশাপাশি তরুণদের জন্য উন্নত মানের কর্মসংস্থানও সম্ভব হতে পারে।

ড. রুশিদান ইসলাম রহমান: সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের (সিডিইআর) এক্সিকিউটিভ চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য