দরিদ্রদের জন্য নগদ অর্থসহায়তা

করোনা সংকটে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। জীবনযাপনের মৌলিক উপাদানগুলো তাঁদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিএসবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশে নেমে এসেছিল। কিন্তু করোনার কারণে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে বেরিয়ে এসেছে। করোনা সংকট দীর্ঘায়িত হলে এ হার আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৬ কোটি ৬৫ লাখের বেশি মানুষকে প্রতি মাসে ২ হাজার ১০০ টাকা নগদ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এতে সরকারের খরচ হবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটি আগামী কয়েক মাস সহায়তা চালু রাখার সুপারিশ করেছে।

গত বৃহস্পতিবার ইউএনডিপির ‘টেম্পোরারি বেসিক ইনকাম: প্রোটেক্টিং পুওর অ্যান্ড ভালনারেবল পিপল ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক মানুষকে নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়। তাদের মতে, বিশ্বের ১৩২টি উন্নয়নশীল দেশের ২৭০ কোটি মানুষের নগদ সহায়তা দরকার। এসব মানুষকে তাঁদের মাসের মূল আয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে।

ইউএনডিপির প্রস্তাব বা সুপারিশ সম্পর্কে সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও দ্বিমত প্রকাশ করেননি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘সংখ্যাটা নিয়ে হয়তো কথা থাকতে পারে। আমাদের এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষ অনেক বেশি। তারা দিন আনে দিন খায়। সন্দেহ নেই, তাদের সহায়তা দরকার।’

যদি সরকার নীতিগতভাবে ইউএনডিপির সুপারিশ গ্রহণ করে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, বাস্তবায়ন কীভাবে হবে? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সরকার বলেছে, করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় টাকার সমস্যা হবে না। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম সরকারের সেই সামর্থ্য আছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে ৬ কোটি ৬৫ লাখ মানুষকে নগদ সহায়তা দেওয়ার পদ্ধতি কী হবে? এর আগে সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে এককালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক তালিকা থেকে মাত্র সাড়ে ১৬ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া গেছে। তালিকা তৈরিতে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বাকিরা এখনো অর্থ পাননি।

গরিব ও অভাবী মানুষের সহায়তার জন্য ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রি, দুস্থ ও বয়স্ক ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিসহ সরকারের আরও যেসব প্রকল্প আগে থেকে চলে আসছে, তা-ও দুর্নীতিমুক্ত নয়। করোনাকালে গরিবের চাল আত্মসাতের জন্য এক হাজারের বেশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন। তাঁদের বাইরে আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

২ হাজার ৫০০ টাকা নগদ বিতরণ নিয়ে সরকার যে লেজেগোবরে অবস্থা করে ফেলেছে, তাতে ইউএনডিপির সুপারিশ অনুযায়ী বিশাল সহায়তা কর্মসূচি নিয়ে তা কতটা সফল করা যাবে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কেননা, এসব সহায়তা প্রকল্প যাঁদের ও যে ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার কথা, তার পুরোটা না হলেও একটা বড় অংশই দুর্নীতিগ্রস্ত। যাঁদের কাজটি তদারক করার কথা, তাঁরা হয় উদাসীন, না হয় অক্ষম।

ভবিষ্যতে যদি সরকার ইউএনডিপির সুপারিশ অনুযায়ী বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ ধরনের কোনো সহায়তা কর্মসূচি হাতে নেয়, তাহলে তালিকা তৈরি থেকে অর্থ বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তালিকা তৈরিতে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি দূর করতে ভোটার আইডি কার্ড ও মুঠোফোন নম্বর কাজে লাগানো এবং এনজিওগুলোর সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। 

প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কাজটি করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।