স্বাস্থ্যের নতুন ডিজির 'ভিক্টিম ব্লেইমিং'

‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে হবে না। দুর্নীতির দায়টা সবার।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের কথাটা শুনে ‘সবার’ মুখের ছবি ভেসে উঠল। সেই সবার মধ্যে কি চিকিৎসা না পেয়ে অসহায় ও করুণভাবে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিরা আছেন? আছেন আইসিইউ না পেয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকেরা? হাসপাতালে ঠাঁই না পাওয়া রোগীকে রাস্তার মধ্যে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচাতে না পেরে যে চিকিৎসক হতাশায় মুষড়ে রাস্তাতেই বসে গেলেন, এই অব্যবস্থাপনার দায়ের ভাগীদার কি তিনিও? তাঁদেরও কি দায়ী করলেন ডিজি মহোদয়? রিজেন্ট কেলেঙ্কারির খলনায়ক-নায়িকা সাহেদ ও সাবরিনা কিংবা নকল মাস্ক সরবরাহকারী শারমিন জাহানের দায় কোন পদ্ধতিতে সবার মধ্যে, অর্থাৎ সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে সমভাবে বেঁটে দেবেন তিনি? অসহায় মা-বাবা কিংবা কোলের শিশুকে নিয়ে অক্সিজেনের সন্ধানে ছুটে বেড়ানো মানুষ আর যারা আমাদের এই অবস্থার মধ্যে ফেলেছে, তারা কি এক? তিনি কি বোঝাতে চাইলেন, এই যে তোমরা অসহায়ভাবে ভুগছ এটা তোমাদেরই কর্মফল, কারণ দুর্নীতির দায়টা সবার—তোমারও যেমন আমারও তেমন! কর্তৃপক্ষ কিন্তু মোটেই দায়ী নয়।

বিভিন্ন নোটিশের নিচে ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’ লেখা থাকতে দেখা যায়। ছোটকালে এসব দেখে আমার মনে হতো, আহা ‘কর্তৃপক্ষ’ নামক বেচারা কত ভালো। কোনো খারাপ কাজের দায়ই তার নয়। ডিজি মহোদয়ের কাছে সরকারও তেমন এক কর্তৃপক্ষ, ‘দুর্নীতির জন্য শুধু তাকে দায়ী করলে নাকি হবে না!’ সরকারের বাইরে তো আর সব আমজনতা। বিরোধী দল থাকলে নাহয় তাদেরও দোষানো যেত, চাইলে তিনি সরকারের আরেক মন্ত্রীর মতো সবকিছুর জন্য বিএনপিকেও দায়ী করতে পারতেন। কিন্তু করেননি, তিনি ‘সবাইকে’ও দায়ী করেছেন, যার মধ্যে আপনি-আমি আছি। সত্যিই নিদারুণ কলিকালে এসে পড়েছি!

কলিকালে বৃক্ষের পরিচয় আর ফল দিয়ে হয় না, কথা দিয়ে হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ডিজি আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম কথা দিয়েই নিজেকে পরিচিত করেছেন। দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া সাবেক ডিজির আসনটি এখন তাঁর। যে আসন ব্যবহার করে করোনা মারামারির সময়ে মানুষের জীবন ও রাষ্ট্রের সম্পদ নিয়ে অকল্পনীয় দুর্নীতিগুলো হয়েছে, সেই আসন একজন যোগ্য ও সৎ সরকারি কর্মকর্তাকে দেওয়া হবে, এটাই ছিল মানুষের চাওয়া। সাবেকের অপসারণ এবং নতুনের আগমনের মধ্যে মানুষ ইতিবাচক পরিবর্তনই দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু কাজের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় পাওয়ার আগে তিনি তাঁর মনোভাবের পরিচয় দিলেন কথায়। অবশ্য কথা বলে তো সাধারণ মানুষ, অসাধারণদের কথা নাকি বাণীর সমান, ডিজি সাহেব বলেন, শোনে জনগণ। তাঁর মুখ থেকে জনগণ শুনেছে, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির জন্য শুধু সরকারকে দায়ী করলে হবে না। দুর্নীতির দায়টা সবার।’

সঙ্গে সঙ্গে এই সবার মুখটি মনে ভেসে উঠল। সেসব অসহায়ের মুখ, করোনা মহামারিতে যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থার ‘ভিক্টিম’ হয়েছেন। ইংরেজিতে একে বলে ‘ভিক্টিম ব্লেইমিং’। অর্থাৎ যে দুর্ভোগ বা নির্যাতনের শিকার হলো, তাকেই তার দুরবস্থার জন্য দোষানো। ঔপনিবেশিক শাসক থেকে শুরু করে স্বৈরাচারীরা এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। ইংরেজ শাসকেরা বলত, উপমহাদেশের মানুষ গরিব, কারণ তারা যোগ্য নয়। বলত, ভারতবর্ষের মানুষ স্বাধীনতার যোগ্য নয়, তাই তারা পরাধীন। এভাবে নিজেদের অপশাসন-লুণ্ঠনের দায় তারা তাদের হাতে শোষিত জনসাধারণের ওপরই চাপাত। যেভাবে দারিদ্র্যকে শোষণ-লুণ্ঠনের ফল হিসেবে না দেখে পুঁজিবাদীরা বলে থাকে, শ্রমিকেরা অলস তাই তারা গরিব। যেভাবে নারী নির্যাতনের জন্য নারীকেই, ধর্ষণের জন্য নারীর চলাফেরা বা পোশাককে দায়ী করে অপরাধীদের আড়াল করা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নয়া ডিজি সেটাই করেছেন। এর সরলার্থ হলো ‘ভিক্টিম ব্লেইমিং’।

করোনা মহামারির সময়ে যখন মানুষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তাদের দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে ক্রুদ্ধ, তখন এসব গণবিধ্বংসী অপরাধীর দায় লাঘবের চেষ্টা যেন কাটা ঘায়ে লবণ ছিটানোর মতো। কোথায় তিনি মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনবেন, তাঁর প্রশাসনকে অতীতের দুর্নীতির জন্য সাবধান করে দেবেন, সেখানে কিনা তিনি দায় চাপানোর জন্য জনগণ ছাড়া আর কাউকে পেলেন না। পরিষ্কারভাবে, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির চক্রকে তিনি আগের কায়দায় চালিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেতই দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, ব্যক্তির বদল হয় ব্যবস্থা বদলায় না। দুর্নীতির শিকারকে দুর্নীতির জন্য দায়ী করা নৈতিক অপরাধ। সেই অপরাধ ডিজি মহাশয় করেছেন।

আমাদের মনে পড়ে, গত বছর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা ও দূষিত পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসার সমালোচনা করা হচ্ছিল। জুরাইনের সামাজিক সংগঠক মিজানুর রহমান তাঁর বাড়ির ট্যাপ থেকে দূষিত কমলারঙা পানির বোতল নিয়ে সেই পানি ওয়াসার মহাপরিচালককে খাওয়ানোর প্রতীকী প্রতিবাদের আয়োজন করেন, তখন ওয়াসার অধিপতি জনাব তাকসিম মিজানুর রহমানকে ‘পাগল’ বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। সেটাও ছিল ভিক্টিম ব্লেমিং।

হ্যাঁ, দেশের মানুষও কমবেশি দুর্নীতি মনোভাবাপন্ন হতে পারে, যদি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রশাসন এবং সমাজ-অর্থনীতির কর্তৃত্ব দুর্নীতিবাজদের হাতে থাকে। এই রকম অবস্থায় দুর্নীতিই হলো একমাত্র মুদ্রা, যা সব জায়গায় চলে। সরকারি সেবা পেতে ঘুষ ছাড়া যখন উপায় থাকে না, তখন মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। এই বেকায়দা পরিস্থিতির দায় কি জনগণের, নাকি যারা দুর্নীতির কলটা চালু রাখে তাদের?

বাংলাদেশ যখন দুর্নীতির শিরোপা অর্জনে হ্যাটট্রিক করছিল, তখন কিন্তু কেউ জনগণকে দুর্নীতির শিরোপা দেয়নি, সেটার দাবিদার ছিল সরকার। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতির চরিত্রই হলো সবাইকে বঞ্চিত করে কিছু লোকের লাভবান হওয়া। এই জন্য দুর্নীতির সুযোগ সবাই পায়ও না, সবাই তার দ্বারা উপকারভোগীও হয় না। বাস্তবে সেটা অসম্ভব। একমাত্র অধিকার আর সেবা সবাইকে দেওয়া সম্ভব, দুর্নীতির সুবিধা যদি সবাই পায়, তাকে তো আর দুর্নীতি বলা চলে না। দুর্নীতি তাই চরিত্রগতভাবে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানের আওতাভুক্ত বিষয়। সেই ক্ষমতাবানেরা যদি নিজেদের বাঁচাতে কৃতকর্মের দায় ভুক্তভোগীদের দেন, তখন বোঝা যায়, চোরকে চোর বলাও এই দেশে আর নিরাপদ নয়।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও কবি।
[email protected]