ক্রিমিনাল অর্থনীতির চেরাগ হাতে নষ্ট নায়ক-নায়িকারা

ফরিদপুরের দুই ভাই বরকত ও রুবেল
ফরিদপুরের দুই ভাই বরকত ও রুবেল

গ্রিক পুরাণে মানুষ আর দেবতাদের মধ্যে আরেক প্রজাতির লোক ছিল। তাঁদের বলা হতো টাইটান। এই টাইটানরাই মর্ত্যলোকের মানুষদের শাসন করতেন। তাঁদের অনাচার চরমে উঠলে অথবা তাঁদের কেউ কেউ দেবতাদের সঙ্গে মারাত্মক বেয়াদবি করে বসলে অলিম্পাস পর্বতের দেবতারা কোনো কোনো টাইটানকে শাস্তি দিতেন বা বরখাস্ত করতেন। সাধারণ মানুষের কষ্ট তাতে না কমলেও অলিম্পাস পর্বতের দেবতারা স্বস্তি পেতেন। আমাদের রাজনৈতিক মাফিয়াদের কারও কারও পতনের গল্পটাও কি তেমন?

এই দেশের সাধারণ মানুষ পিঁপড়ার মতো শক্তিশালী। পিঁপড়া নিজের ওজনের চেয়ে আট গুণ বেশি ভারী জিনিস টানতে পারে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বহন করতে হয় বিপুল ওজনদার মাফিয়াদের লুণ্ঠনের ভার। এই মাফিয়ারা উল্কার মতো। খুব দ্রুত উত্থান হয়। উঁচুতে উঠতে উঠতে যাঁরা নক্ষত্র হয়ে যান, তাঁদের ঘিরে থাকে জ্যোতির্বলয়। তাঁদের পতন সহসাই আর হয় না। পতন হয় ছোট ছোট উল্কাপিণ্ডের। লেজে আগুন নিয়ে তাঁদের পতনদৃশ্য মানুষ দেখতে পায়।

পাপিয়া–সম্রাট থেকে শুরু করে সাহেদ–সাবরিনার পর পতিত উল্কা হিসেবে আলোচিত হচ্ছেন ফরিদপুরের যুগলশেঠ রুবেল–বরকত ভাইয়েরা। এঁরা টিকটিকির লেজের মতো। টিকটিকির লেজ যেমন খসে গেলে আবারও গজায়, তেমনি নতুন মুখেরাও মাফিয়াতন্ত্রের লেজের মতো গজাতে থাকে। রাজনীতির চেরাগে ক্ষমতার ঘষায় এরা পায় সব সম্ভবের জাদুকরী ক্ষমতার কৃপা।

বাংলাদেশ আগে ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু এখনকার অবস্থাকে শুধু দুর্নীতি বললে চুরি আর ডাকাতির পার্থক্য থাকল কই? পার্থক্যটা চুরি ও ডাকাতির পার্থক্যের মতো। দেশটা যখন দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল, তখনো একটা সিস্টেম ছিল। ঘুষ ও বখরার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার লোকেরা তখনো সম্পদ বানাতেন। সেই বখরা হয়তো ৫ থেকে ১০ শতাংশই হতো। কিন্তু এখন জোর থাকলে শতভাগও লোপাট করা যায়। দলের জোরে, নামের জোরে, ক্ষমতার জোরে।

চোর চুরি করে কৌশলে, লুকিয়ে। লুকিয়ে করার কারণে সবটুকু কেড়ে নিতে তার অসুবিধা। কিন্তু ব্যাংক–বিমা, জায়গা–জমি, প্রতিষ্ঠান ও পদ দখলে বলপ্রয়োগ করতে হয়। বলপ্রয়োগের মিশেলের জন্যই দুর্নীতির চেয়ে এটা চরিত্রগতভাবে আলাদা। ঢাকার এক ব্যাংকের এমডিকে সিকদারদের দুই ভাইয়ের গুলি ও অপহরণ কিংবা ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের উত্থানের ইতিহাস বলপ্রয়োগের কলঙ্কিত ইতিহাস। এই ইতিহাস আইন, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও সভ্যতাকে গুঁড়িয়ে মাথা তোলার ইতিহাস। দুর্নীতিতন্ত্র না বলে একে ঠগিতন্ত্রের ক্রিমিনাল অর্থনীতি বলাই যথাযথ।

এই ঠগিতন্ত্র কেবল বাংলাদেশের ব্যাপার না। দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কটি দেশ এই পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের ইউসিএল প্রেস থেকে ‘দ্য ওয়াইল্ড ইস্ট: ক্রিমিনাল পলিটিক্যাল ইকোনমিজ ইন সাউথ এশিয়া’ নামের একটি সাড়াজাগানো বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় বললে, ‘বুনো পূর্ব: দক্ষিণ এশিয়ার অপরাধমূলক রাজনৈতিক অর্থনীতিগুলো’। সহজ ভাষায় রাজনৈতিক ঠগিতন্ত্রের অর্থনীতি। আমেরিকার বুনো পশ্চিমের মতো এটা হলো এশিয়ার বুনো পূর্ব। আমেরিকায় চলত সোনা নিয়ে বন্দুকবাজি। আমাদের এখানে চলে টাকা বানানোর ঠগবাজি।

ভঙ্গুর গণতন্ত্র ও দুর্বৃত্ত অর্থনীতি এই ধরনের ‘লিজেন্ড’, ‘গডফাদার’, ‘আম্মাজান’, ‘বড় ভাই’, ‘বস’, ‘দাবাং’ চরিত্রের উর্বর বীজতলা। বসবাসের অযোগ্য, চরম বৈষম্যপূর্ণ, নোংরা ও অপরাধে ভরা নগরগুলোতে এরা গড়ে তোলে নিজস্ব স্বর্গ, বাহিনী আর রাজত্ব। জমায় মজা ও মানিকে (অর্থ) একাকার করে ফেলার ওস্তাদি। গত এক দশকে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর বাংলাদেশে ঘটেছে, তার অপরাধজগতের আলো-আঁধারিতে এঁদের বিচরণ।

সমাজে অনিশ্চয়তা যত বাড়ে, ততই এঁদের মওকা। এঁদের ক্যারিয়ারে টাকার খেলাকে সঙ্গ দেয় নারী, মদ আর ফুর্তি। সাধারণত এঁদের পারিবারিক জীবন হিন্দি সিরিয়ালের মতো কুটিল এবং যৌনজীবন হয় বিকৃত। ভোটের রাজনীতিতে সম্ভাবনা বজায় রাখতে রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত এঁদের খুঁটি পোঁতা থাকে। এসব চালাতে হলে থাকতে হয় আইনের ঊর্ধ্বে। আইনের লোকজনের সঙ্গে খাতির ছাড়া সেটা অসম্ভব। এঁরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কলকবজা। রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের অপরাধীকরণের এজেন্ট এঁরা।

এঁরা গতিশীল, খোলস বদলাতে ওস্তাদ। নেতা থেকে ব্যবসায়ী, মাফিয়া থেকে এমপি, লাভজনক সংস্থার পদাধিকারী থেকে বড় ব্যবসায়ী অথবা নেতা হওয়াই এঁদের আত্মজীবনী। এখন তো বিদেশ অবধি এঁদের দৌরাত্ম্য। সেটাই ‘সেকেন্ড অপশন’, সেটাই ‘সেকেন্ড হোম’। সম্প্রতি কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি এমপি পাপুল তো এঁদেরই বর্ধিত সংস্করণ। ক্রিমিনাল অর্থনীতিতে কয়েক বছরেই একেকজন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যেতে পারেন।

হাতে গোনা সম্ভব হয় না বলে এঁরা টাকা বা স্বর্ণ ওজন দিয়ে পরিমাপ করেন, রূপকথার কায়দায় মন্দার সময় বালিশের মধ্যে কিংবা গর্ত খুঁড়ে টাকা রাখেন। রাতারাতি এঁরা বিদেশের বড় শহরে বিরাট বিরাট ভবন বা প্রাসাদ কিনে ফেলেন। করমুক্ত টাকা রাখার জায়গা না পেয়ে অবিশ্বাস্য মূল্যের ঘড়ি, অলংকার বা গাড়ি কেনেন। আখেরে সবকিছু ম্যানেজ করে ফেলার জাদু এঁদের আয়ত্ত। এঁরা দেখনেওয়ালা নন, এঁরা করনেওয়ালা। রাজনীতির শিল্পকে এঁরা মাফিয়াগিরির শিল্পে পরিণত করেন। কিছুদিন আগে ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো পাপিয়ার হাতের লাঠি সেই মাফিয়াগিরির প্রতীক। ভারতের ‘লেডি দাবাং’ পার্তিয়ালা রবির সঙ্গে তুলনা চলে তাঁর।

একেকজন মাফিয়া ‘বস’কে ফুলে–ফলে ফুটিয়ে তুলতে মোটামুটি পাঁচ বছর লাগে। এই কাহিনির প্রথম অধ্যায়ের সাক্ষী জেলা শহর—পাপিয়ার বেলায় নরসিংদী, দুই ভাইয়ের বেলায় ফরিদপুর। এই যাত্রায় যুব নেতা–নেত্রীরা প্রথমে দলের ছোট নেতা হয়ে ক্ষমতার নজরে আসেন। নজরে আসতে প্রতিযোগী ও প্রতিপক্ষকে রক্তাক্তভাবেও কুপোকাত করতে হয়। ওপরের মহলের চাহিদা মেটানোর যোগ্যতা যাঁর বেশি, তিনি পান উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি। তারপর শুরু হয় পদ ধরে রাখার যুদ্ধ, টাকা বানানোর সার্বক্ষণিক শ্রেণিসংগ্রাম। চালিয়ে যেতে পারলে শ্রেণি–উত্তরিত এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়। একবার হয়ে গেলে আর ছোঁয় কে? ব্যর্থ হলে বিদেশে পালানোর সুযোগ থাকে, ‘বেগমপাড়ার’ ঠিকানা থাকে। লুণ্ঠিত সম্পদ বৈধ করে সুসময়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকার গুণ এঁদের আছে। এই খেলাই চলছে হরদম হরদম।

ক্ষমতার বীজতলায় মাথা গজানো পাতি নেতারা স্বপ্ন দেখে শাহেদ কিংবা সম্রাট ভাইদের মতো হবে। এঁদের অভিযাত্রা রোমাঞ্চকর, শ্বাসরুদ্ধকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। একজন প্রতিষ্ঠিত মাফিয়ার নেতা, এমপি, শিল্পপতি, বিজনেস ম্যাগনেটে পরিণত হওয়ার শেষ ধাপটা খুব বিপজ্জনক। ক্যাসিনো সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ বা পাপিয়ারা শেষ ধাপে আটকে গেলেন। যেমন আটকালেন ফরিদপুরের দুই ভাই। এর মানে এই নয় যে ক্রিমিনাল অর্থনীতি খাবি খাচ্ছে। ক্ষমতার বীজতলায় অপেক্ষা করছে অজস্র নতুন মুখ। প্রতিটি বিতর্কিত নির্বাচনী বসন্তে এঁদের সংখ্যা বাড়ে। দেশটাও আরও এগিয়ে যায় দুর্নীতির ডোবা থেকে ঠগিতন্ত্রের খাদের দিকে।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও কবি।
[email protected]