নিরাপদ সড়ক আন্দোলন

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুজন শিক্ষার্থী নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনা শিক্ষার্থীদের দারুণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষও। সে সময় সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদে দ্রুততম সময়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন করেছিল। 

শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হলেও দুই বছর পরও কারও কারও বিরুদ্ধে মামলার খড়্গ ঝুলছে। ২৯ জুলাই সেই প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ছিল, ‘ভয় আর মামলাতে আটকে গেছে শিক্ষার্থীদের জীবন’। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে অনেককে দীর্ঘদিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এখনো তাঁদের মাথার ওপর মামলা ঝুলছে। করোনার আগ পর্যন্ত প্রতি মাসে আদালতে হাজিরাও দিতে হয়েছে। 

সে সময় যেসব শিক্ষার্থী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের কেউ আইন হাতে তুলে নেননি। বরং ১০ দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও তাঁরা পালন করেছেন। যেসব যানবাহন সড়ক আইন ভঙ্গ করেছে, সেসব যানবাহন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করে আইনানুগ নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। অথচ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে থানা-পুলিশের মামলায় বলা হয়েছে, তাঁরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, পুলিশের সরকারি যানবাহনে ভাঙচুর ও পুলিশ ফাঁড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করেছেন। 

অন্যদিকে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির ক্যাডাররা হেলমেট পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর যে একের পর এক হামলা চালাল, তাদের কারও বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেনি। 

যে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছেন, তাঁরা পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর করবেন এবং পুলিশের ফাঁড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করবেন, এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনও প্রমাণ আছে, যে শিক্ষার্থী কোনোভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি অবলোকন করছিলেন, তাঁকেও ধরে নিয়ে জেলখানায় পাঠানো হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ১৫টি পর্যন্ত মামলা করা হয়েছে। এটাই শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতিদান। 

দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার কারণে অনেকের পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। দুই বছর পার হওয়ার পরও মামলা প্রত্যাহার না হওয়ায় তাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। ঢাকার পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, মামলাগুলো পেইন্ডিং বা ঝুলন্ত আছে। মামলা ঝুলন্ত থাকার অর্থ, পুলিশ এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। যে মামলার কোনো ভিত্তিই নেই, সে মামলার তদন্ত হবে কি? 

এখানে পুলিশ কেবল একপেশে ভূমিকা নেয়নি, আইনের অপব্যবহারও করেছে। সরকার-সমর্থক হেলমেট বাহিনীকে ধরা অনেক দূরের কথা, একটি মামলা পর্যন্ত করেনি। অথচ তারা প্রকাশ্যে হামলা চালিয়েছে। অতীতে বাংলাদেশে রাস্তায় যত আন্দোলন হয়েছে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ছিল সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল। তাঁদের আন্দোলনের মুখে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সরকারের উচিত সেই আইন বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়া। আইনের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। সেটি না করে মামলার নামে একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের দুই বছর ধরে হয়রানি করে আসছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। 

অবিলম্বে শিক্ষার্থীসহ সড়ক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করা হোক।