এখন অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করার সময় এসেছে

বিশ্বজুড়ে চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ এ মুহূর্তে পৃথিবীর ১৭তম দেশ। ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার; মারা গেছেন তিন হাজারের বেশি মানুষ। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাস বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে নানা উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়েছে। সেসবের মধ্যে বেশি আলোচনায় এসেছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষার বিষয়টি। পরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে ভাইরাস সম্পর্কে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ইংরেজি ভাইরাস শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘ভিরুস’ (virus) থেকে, এর অর্থ বিষ। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে ভাইরাস বলতে বোঝায় এমন অতি ক্ষুদ্র ‘সাবমাইক্রোস্কোপিক ইনফেকশাস এজেন্ট’, যা কোনো প্রাণিকোষের ভেতরে ঢোকার পর সেই কোষ বা প্রাণিদেহকে আক্রান্ত করে। ভাইরাস অন্যান্য অণুজীব বা কোষের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। একটি অণুজীবে ডিএনএ ও আরএনএ উপস্থিত থাকে। কিন্তু ভাইরাসে থাকে এ দুইয়ের যেকোনো একটি; হয় ডিএনএ, নয় আরএনএ। নভেল করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস; এর আকার মুকুটের মতো বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে করোনা।

অন্যান্য উপাদানের পাশাপাশি প্রোটিনও ভাইরাসকে আচ্ছাদিত করে রাখে। ভাইরাস উদ্ভিদসহ যেকোনো ধরনের প্রাণিদেহকে আক্রান্ত করতে পারে; প্রাণিকোষে ঢোকার পর নিজেকে বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারে। অর্থাৎ, কোনো ভাইরাস প্রাণিদেহে ঢোকার পর ওই প্রাণীর কোষে মূল ভাইরাসটির অসংখ্য প্রতিরূপ তৈরি হয় এবং সেগুলো ওই প্রাণীর (যাকে বলা হয় ‘হোস্ট’) বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দখল করে ফেলতে পারে। বলা প্রয়োজন, ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ থেকে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। ভাইরাসকে আচ্ছাদনকারী প্রোটিন তার অ্যান্টিবডি তৈরিতে সাহায্য করে। 

ভাইরাস নানাভাবে এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করতে পারে। যেমন আক্রান্ত প্রাণীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে, আক্রান্ত প্রাণিদেহের ব্যবহৃত সামগ্রী থেকে, ইত্যাদি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের বেশ কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখা যায়। তবে অনেকের তা না–ও দেখা যেতে পারে। উপসর্গহীন আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যদের সংস্পর্শে গেলে অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। এ কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। পরীক্ষার ক্ষেত্রে পিসিআর (পলিমিরেজ চেইন রিঅ্যাকশন) পদ্ধতিকে যথাযথ মনে করা হয়। এ পদ্ধতির মূল কাজ জীবন্ত প্রাণিদেহে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা। এ পদ্ধতিতে খুব স্বল্পসংখ্যক ভাইরাসের উপস্থিতিও শনাক্ত করা সম্ভব। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগে পিসিআর পদ্ধতির পরীক্ষার সুবিধা ছিল খুব অল্পসংখ্যক ল্যাবরেটরিতে; মূলত হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি ও যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা করা হতো এ পদ্ধতিতে। বারডেম হাসপাতালে ১৯৯৫ সাল থেকে পিসিআর যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এ পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়। আমাদের জানামতে, কিছু বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতেও পিসিআর মেশিন আছে, কিন্তু সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়নি। উল্লেখ্য, পিসিআর একটি মলিকুলার ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাবরেটরি দরকার হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াও সঠিকভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য মানসম্পন্ন পরিচালনা পদ্ধতি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর থাকতে হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারতসহ ইউরোপে উন্নত মানের যেসব কিট ব্যবহৃত হয়, তা নমুনায় স্বল্পসংখ্যক ভাইরাস থাকলেও তা শনাক্ত করতে সক্ষম। যদিও টেকনিক্যালি এ কিট নমুনায় থাকা একটিমাত্র করোনাভাইরাসকেও শনাক্ত করতে পারে। এটা নির্ভর করে কিটের শনাক্তকরণ সীমার ওপর। গত ছয় মাসে খুবই উন্নত মানের কিছু কিট উৎপাদিত হয়েছে, যেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফডিএ এবং আইভিডির সনদপ্রাপ্ত। এসব কিটের মাধ্যমে ভুল রিপোর্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ মানের কিট ব্যবহার এবং যথাযথ পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ না করায় অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষার ভুল রিপোর্ট এসেছে। এ দেশে করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে সংক্রমণের এটাই উল্লেখযোগ্য কারণ। পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনে চলতে হয়। নাক বা মুখের যথাযথ স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা এবং যথাযথ ‘মিডিয়ার’ মাধ্যমে তাকে স্থানান্তর করা খুবই জরুরি। নমুনা সংগ্রহের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পরীক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহের পর তা ল্যাবরেটরিতে স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই স্যালাইন ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে নমুনার মান হ্রাস পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। 

বাংলাদেশে এখন করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি এর অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করারও সময় এসেছে। করোনাকালে সামনের সারির কর্মীদের বাছাই করতে এ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যঁাদের শরীরে এর অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাঁদের আবার সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। ফলে তাঁরা যেকোনো খাতে সামনের সারির কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারেন। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ইংল্যান্ডের ওমেগা নামের একটি সংগঠন থেকে প্রায় ৯০০টি অ্যান্টিবডি পরীক্ষার কিট পেয়েছে। আমরা এগুলো দিয়ে সমিতির বিভিন্ন হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ কর্মীদের বিনা মূল্যে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে সক্ষম হই। পরীক্ষার আওতাধীন স্বাস্থ্যকর্মীদের ২৫ শতাংশ এবং সাধারণ কর্মীদের ১২-১৫ শতাংশের শরীরে আমরা কোভিড-১৯–এর অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দেখতে পাই। যাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাঁদের সংস্পর্শে করোনা সংক্রমণের কোনো ঝুঁকি আর নেই; সুতরাং তাঁরা বিভিন্ন খাতে নির্দ্বিধায় সামনের সারির কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারেন। এমনকি নিজেদের প্লাজমা দান করে কোভিড–১৯ রোগীদের চিকিৎসায় সহায়তাও করতে পারেন। আর পরীক্ষায় যাঁদের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি (নেগেটিভ) বলে জানা যাবে, তাঁরা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার মাধ্যমে কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারেন। ভবিষ্যতে টিকা দেওয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলো কি না, তা জানতেও এ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ড. মাহমুদ হোসেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক 

ড. শওকত হাসান: বারডেমের ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস বিভাগের পরিচালক

ডেভিড রবার্টস: যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও গবেষক

ড. সনজন দাস: স্ট্রাকচারাল জেনোমিক্সবিষয়ক বিজ্ঞানী

এ কে আজাদ খান: বিশিষ্ট চিকিৎসক, গবেষক ও সমাজকর্মী। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি