ত্যাগের পরীক্ষা, সফলতার উদ্যাপন

ঈদ মানে আনন্দ, কোরবানি হলো ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি বিধান। কোরবানি ঈদ হলো ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সফলতার খুশি। এটি মূলত ইবাদতের আনন্দ ও আত্মত্যাগের উৎসব। এই কোরবানি মানব ইতিহাসের সূচনা থেকে বিদ্যমান।

মুসলমানের দুটি ঈদ, ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ এবং ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আজহা অর্থ হলো কোরবানি, জবাই বা জবেহ করা অথবা কোরবানির পশু; আজহার আরেক অর্থ হলো ছাগল, তাই একে বকরি ঈদও বলা হয়। পরিভাষায় কোরবানি হলো জিলহজের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর উদ্দেশে নির্দিষ্ট জন্তু জবাই করা। 

জিলহজ মাসের প্রথম দশক ও শুক্লপক্ষ পুরোটাই ফজিলতপূর্ণ। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘উষার শপথ! আরও শপথ (জিলহজের প্রথম) দশ রজনীর! এবং শপথ জোড় (ঈদের দিন) ও বেজোড় (আরাফার দিন) এর।’ (আল–কোরআনুল করিম, সুরা-৮৯ ফজর, আয়াত: ১-৩, ই. ফা.)। জিলহজের ১ থেকে ৯ তারিখ প্রতিদিনের রোজা এক বছরের রোজার সওয়াব এবং প্রতি রাতের ইবাদত এক বছরের ইবাদতের সমান সওয়াব। (তিরমিজি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৫৮)। জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ হজের কার্যক্রম, ৯ থেকে ১৩ তারিখ আইয়ামে তাশরিক তকবির বলা ওয়াজিব, ৯ তারিখ আরাফা দিবসের রোজা বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা, আবার ৯ তারিখ হজ, ১০ তারিখ ঈদ, ১০ থেকে ১২ তারিখ কোরবানি। এবং ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের রোজা, যা প্রতি মাসেই রয়েছে। একসঙ্গে এত অধিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ইবাদত অন্য কোনো মাসে দেখা যায় না।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কোরবানি করেন বাবা আদম (আ.)–এর পুত্রদ্বয় হাবিল (রা.) ও কাবিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আদম (আ.)–এর পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত আপনি তাদেরকে শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনেরটা কবুল হলো না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিনদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা-৫ মায়িদা, আয়াত: ২৭)। তাকওয়া ও ইখলাস তথা বিশুদ্ধ নিয়ত কোরবানি কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। কোরআনের বাণী: ‘আল্লাহর নিকট ওদের গোশত রক্ত পৌঁছায় না; বরং পৌঁছায় তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৭)।

সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য কোরবানি একটি ওয়াজিব আমল, যা কার্যত ফরজের মতোই বাধ্যতামূলক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (জবাই করে)।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৪)। ‘আমি তোমাকে প্রাচুর্য দান করেছি। তুমি তোমার রবের জন্য সালাত আদায় করো এবং কোরবানি (পশু জবাই) করো।’ (সুরা-১০৮ কাউসার, আয়াত: ১-২)। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যার পশু জবাই দেওয়ার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২১২৩, মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা: ১২০, হাদিস: ৮২৭৩, জামে সহিহ্ আলবানী)। শিশু তথা নাবালকের ওপর কোরবানিসহ কোনো ফরজ ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়। হিজড়ারা মূলত নারী বা পুরুষ, তাই তারাও প্রাপ্তবয়স্ক এবং সামর্থ্যবান হলে তাদের ওপর নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো কোরবানিও ওয়াজিব হবে।

কোরবানি প্রভুপ্রেমের পরীক্ষা। কালক্রমে যুগপরম্পরায় বিভিন্নরূপে কোরবানির প্রচলন ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)–এর কোরবানি। বিবরণটি পবিত্র কোরআনে এসেছে, ইব্রাহিম বললেন, ‘হে বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে আমি কোরবানি করছি, তোমার অভিমত কী?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’ যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহিম তার পুত্রকে কাত করে শোয়াল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই বাস্তবায়ন করলে!’ এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয়ই এটা ছিল সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান (দুম্বা) কোরবানির মাধ্যমে। আমি এটা পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম। ইব্রাহিমের জন্য অভিবাদন! আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও শুভেচ্ছা। (সুরা-৩৭ সফফাত, আয়াত: ১০০-১১০)।

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার দিনের ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রতিটি ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর তাকবির বলা ওয়াজিব। ভুলে গেলে যখনই স্মরণ হবে তখনই পড়ে নিতে হবে। ঈদের নামাজে যাওয়া–আসার পথে এই তাকবির বলা সুন্নত। তাকবিরটি এভাবে বলা সুন্নাত ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ অর্থাৎ আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নাই, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা’। (সুনানে তিরমিজি)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com