আওয়ামী লীগের বর্ধিত সঞ্চয় ও 'ভাই রাজত্ব'

এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে কতগুলো বিধান জারি করেছিল। এর একটি হলো ২০২১ সালের মধ্যে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। আরেকটি বিধান ছিল প্রতিবছর দলগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া। দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলের মতামত নেওয়ার কথাও বলেছিলেন তাঁরা।

এসব বিধান মেনেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মাঝামাঝি এসে দেখা যাচ্ছে, কোনো দলই ৩৩ শতাংশ পদ নারীর জন্য নির্দিষ্ট রাখা দূরে থাক, কাছাকাছিও আসতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এটি অনেকটা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার শামিল।

শামসুল হুদা কমিশন আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিলের যে বিধান চালু করেছিল, সেটি মোটামুটি সব দলই মেনে চলেছে। অন্তত তারা নির্বাচন কমিশনে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের ২০১৯ সালের হিসাবে দেখা যায়, দলীয় তহবিলে তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ২০১৮ সাল শেষে দলটির তহবিলে জমা ছিল ৩৭ কোটি ৫৬ লাখ ৩ হাজার ৮৩৮ টাকা। ২০১৯ সাল শেষে জমা আছে ৫০ কোটি ৩৭ লাখ ৪৩ হাজার ৫৯৩ টাকা। গত বুধবার আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এবং দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দেন ইসি সচিবের কাছে।

আওয়ামী লীগের সঞ্চয়ের মধ্যে ৪০ কোটি টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখা আছে। গত বছর দলের আয় হয়েছে ২১ কোটি ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৩০ টাকা। একই সময়ে দলটি ব্যয় করেছে ৮ কোটি ২১ লাখ ১ হাজার ৫৭৫ টাকা।

আওয়ামী লীগের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আগের বছরের মতোই দলের আয়ের একটি বড় অংশে এসেছে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করে। এই খাতে দলের আয় ১২ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সম্মেলন বাবদ দল পেয়েছে ৩ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০০ টাকা। ব্যাংক লভ্যাংশ পেয়েছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার ২২৩ টাকা। সাংসদদের চাঁদা থেকে এসেছে ১ কোটি ৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। বাকি টাকা এসেছে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মাসিক চাঁদা, জেলাভিত্তিক প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ চাঁদা, সদস্য ফরম বিক্রি, কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের হল ভাড়া, পত্রিকা প্রকাশনা-বিজ্ঞাপন, পুস্তক বিক্রিসহ অন্যান্য খাত থেকে।

হিসাবে সবচেয়ে বেশি ৩ কোটি ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ টাকা ব্যয় হয়েছে দলের জাতীয় সম্মেলনে আয়োজনে। কর্মচারীদের বেতন, বোনাস, আপ্যায়ন ও অন্যান্য খাতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৭০০ টাকা। বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৮৬৫ টাকা। সভাপতির দলীয় কার্যালয়ের ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে ৫৫ লাখ টাকা।

বিএনপি ২০১৯ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাব এখনো জমা দেয়নি। তবে ২০১৮ সালে তাদের আয় ছিল ৯ কোটি ৮৬ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ টাকা এবং ব্যয় ৩ কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার ১৪৩ টাকা।

রাজনৈতিক দলগুলার দেওয়া আয়-ব্যয়ের এই হিসাবের যথার্থতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন। কেননা দলের নেতা-কর্মীদের চাঁদা হিসেবে যা দেখানো হয়, তা আদৌ তাঁরা দেন কি না? তার পরও এই হিসাবের ইতিবাচক দিক হলো ছোট-বড় ডান-বাম-মধ্য সব দলকে নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ একটি হিসাব নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে হয়। কমিশন চাইলে এটি যাচাই করেও দেখতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো কমিশনই রাজনৈতিক দলগুলোকে আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন করেনি।

পৃথিবীর সব দেশেই ক্ষমতাসীন দলের আয়-রোজগার বেশি থাকে। সেদিক থেকে ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের আয় ও সঞ্চয় ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই, আওয়ামী লীগ বছরে কত টাকা আয় ও ব্যয় করল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিকভাবে দলটি কতটা লাভবান হলো।

একটি দলের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাব হয়ে থাকে তার জনপ্রিয়তা, ভাবমূর্তির ওঠানামার ওপর। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সঞ্চয় বরাবরই ঋণাত্মক হয়। ক্ষমতার মেয়াদ যত বাড়ে, রাজনৈতিক সঞ্চয় বা পুঁজি তত কমতে থাকে। অন্যদিকে বিরোধী দলের রাজনৈতিক সঞ্চয় বাড়তে থাকে। চাঁদের যেমন নিজের কোনো আলো নেই, সূর্যের আলো ধার করে বিলি করে, তেমনি আমাদের দেশে বিরোধী দলগুলোও এমন কোনো কাজ করে না, যাতে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়তে পারে। বরং সরকারের জনপ্রিয়তা কমার সুযোগটাই তারা নেয়। অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের ফলাফলে সেটাই দেখা গেছে।

জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের আরেকটি মাপকাঠি হলো নেতা-কর্মীদের আচরণ। ক্ষমতার আয়ু যত বাড়তে থাকে, তাঁদের আচরণও উৎকটভাবে ধরা দেয়। বিভিন্ন স্থানে ‘ভাই রাজত্ব’ ও ‘বাহিনী সাম্রাজ্য’ গড়ে ওঠে। আগে রাজনৈতিক দলের নামে বিভিন্ন ক্যাডার বাহিনী গড়ে উঠত। এখন ভাই রাজত্বই সেই ক্যাডারের ভূমিকা নিয়েছে।

সরকার গত ৯/১০ মাসে নিজ দলের যে নেতা-কর্মীদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র, তাঁদের কয়েকজনকে ধরেছে। এদের প্রত্যেকের কাহিনি অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যখন সরকার ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযান চালিয়ে একের পর এক আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাকড়াও করতে থাকল, তখন তাঁদের দুর্নীতির খতিয়ান দেখে অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। এরপর পুরান ঢাকার একটি ওয়ার্ড কমিটির নেতা দুই ভাইয়ের বাসায় নগদ টাকার ব্যাংক আবিষ্কৃত হলে মানুষ আরও হতবাক হলেন। কিন্তু সেই বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই যখন নরসিংদীর এক যুবলীগ নেত্রীর কাহিনি প্রকাশিত হতে থাকল, তখন আগের বিস্ময় আর বিস্ময় থাকল না, স্বাভাবিক বলে মনে হলো।

এর পরই করোনা চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের অবিশ্বাস্য কাহিনি সামনে এল। তিনি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে থাকুন বা না থাকুন, এসব করেছেন দলের নাম ভাঙিয়ে। কিছুদিন না যেতেই প্রকাশিত হলো ফরিদপুর আওয়ামী লীগের দুই ভাই উপাখ্যান, যাঁরা আট-দশ বছর ধরে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেননি। ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের সঙ্গে ফুটনোটের মতো করে খুলনায়ও ইউনিয়ন পর্যায়ের তিন ভাইয়ের রোমাঞ্চকর কাহিনি বেরিয়ে আসে। সেখানে আইনের শাসন বলতে কিছু ছিল না। তিন ভাই যা বলতেন, সেটাই সবাইকে শুনতে হতো। অন্যায়ের প্রতিকার চাইতে গিয়ে সম্প্রতি তিনটি প্রাণ ঝরে গেছে। এর আগে পিরোজপুরে চার ভাই, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে দুই ভাইয়ের দখলদারির কাহিনিও পত্রিকায় এসেছে।

এই যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে একের পর এক ভাই কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে (আরও নির্দিষ্ট করে বললে সরকার প্রকাশ করছে) তাতে দলটির হিসাবের খাতায় রাজনৈতিক দায়দেনা বেড়ে চলেছে। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের ‘ভাই রাজত্ব’ চলছে। কোথাও মন্ত্রীর ভাই মন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাবান। কোথাও সাংসদের ভাই সাংসদের চেয়ে বেশি দাপট দেখান।

এই ভাই রাজত্ব ও ভাইয়ের তথাকথিত পৃষ্ঠপোষকদের হাত থেকে দলকে মুক্ত করতে না পারলে আর্থিক হিসাবে আওয়ামী লীগের সঞ্চয় যতই বাড়ুক না কেন, রাজনৈতিক সঞ্চয় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সময় লাগবে না।