ভাইরাসের পৃথিবীতে মানুষের উৎসব

উৎসব করব না করব না, এ নিয়ে এই মুহূর্তে আমরা কিছুটা দ্বিধান্বিত। এক পরাক্রমশালী আণুবীক্ষণিক ভাইরাস, পুরো পৃথিবীর মানুষকে শঙ্কিত–উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গত প্রায় ছয় মাস পুরো পৃথিবীর অর্থনীতির চাকা গতিহীন। এ অবস্থায় অমোঘ নিয়মে আসা উৎসব নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিধা কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু মানুষ কি থেমে থেকেছে কখনো? সে নজির নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম অতিমারির নাম ইনফ্লুয়েঞ্জা, খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালে তা ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া, মধ্য এশিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায়। এরপরেই আছে প্লেগ। খ্রিষ্টপূর্ব ২২৯-২২৬ সালে গ্রিস, লিবিয়া, ইথিওপিয়া ও মিসরে যার বিস্তার ঘটেছিল। এরপর আরও বহু অতিমারির মুখোমুখি হতে হয়েছে পুরো পৃথিবীকে; দীর্ঘ সময় ধারাবাহিকভাবে ভুগিয়েছে প্লেগ। গুটিবসন্ত, কলেরা—সবই আমাদের জানা অতিমারির নাম। খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে ঘটে চলা এইসব অতিমারি একদিকে যেমন মানুষ ক্ষয়ের জন্য দায়ী, তেমনি পৃথিবীর এগিয়ে চলার জন্যও এগুলো ইন্ধন হিসেবে কাজ করেছে।

অণুজীববিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবীতে আনুমানিক ৫ হাজার প্রজাতির ভাইরাস আছে। সেসবের মধ্যে মাত্র ২০০ প্রজাতি সত্যিকার অর্থে বিপজ্জনক। এই শ দুয়েক বিপজ্জনক ভাইরাসের মধ্য থেকেই কখনো কখনো দু–একটা জেগে ওঠে এবং বিপত্তি ঘটায় কোনো না কোনোভাবে। তাতেই পৃথিবী প্রায়–অচল হয়ে পড়ে। এটি ভয়ংকর তথ্য নিঃসন্দেহে। কিন্তু এর বিপরীতে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাইরাসের অবদান ভুললে চলবে না।

ফ্রান্সপ্রবাসী বাংলাদেশি অণুজীববিজ্ঞানী মইনুল হাসান প্রথম আলো অনলাইনে ‘ভাইরাস বন্ধু না শত্রু’ শিরোনামে একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছিলেন। সে লেখার সূত্র ধরে বলা যায়, গত বছর ঈদে আমরা কেমন আনন্দ করেছিলাম কিংবা গত ঈদুল ফিতরে আমরা কতটা ম্রিয়মাণ হতে হতেও আনন্দে ভেসেছি, ঈদের দিন সকালে খাওয়া চমৎকার সুবাসিত সেমাইয়ের স্বাদ কেমন ছিল, নতুন জামা কেনা হয়নি বলে মনে কতটা কষ্ট ছিল, সেগুলো যে এখনো আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করে রেখেছে, এর মূলে রয়েছে ভাইরাস।

সেই কবে, মানুষের আবির্ভাবের উষালগ্নে, মানুষ যখন কেবল দু পায়ে ভর করে পৃথিবীর বুকে দাঁড়াতে শিখছে, তারও বহুকাল আগে মানুষের অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষেরা এক বিশেষ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। সে সংক্রমণের কারণে মানুষের মস্তিষ্ক স্মৃতি সংরক্ষণের বিস্ময়কর গুণটির অধিকারী হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা। অন্যদিকে দেহের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সুস্থ রাখার জন্যও কিন্তু ভাইরাসকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত মানুষের হাতে বড় অস্ত্র ভাইরাস নিজেই। অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে কিংবা শিল্পক্ষেত্রে এর ব্যবহারের গল্প দিন দিন বাড়ছে। ভাইরাসের এই কল্যাণমুখী ব্যবহার আমাদের জন্য যে ‘শাপে বর’ হিসেবে দেখা দেবে, অণুজীববিজ্ঞানীরা সে পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন অনেক আগেই।

ভাইরাসের গুণকীর্তন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বাস্তবতাটা খানিক বোঝার চেষ্টা করাটাই মুখ্য। আমরা ভাইরাসের সমুদ্রে ডুবে আছি। কখনো কখনো হাবুডুবু অবস্থা হয় বটে, কিন্তু সেটা মানুষ সামলেও ওঠে। কিছুটা সময় প্রয়োজন হয় তার জন্য। পুরো পৃথিবী এই মুহূর্তে চেষ্টা করে চলেছে করোনাভাইরাস থেকে যত দ্রুত সম্ভব মুক্তি পাওয়ার জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনের প্রতি ইতিবাচক থাকাও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার বড় উপায়।

দুই

পৃথিবীর ইতিহাসে সম্ভবত এই ২০২০ সাল একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে একই সঙ্গে অতিমারির কালে দুটো উৎসব উদ্‌যাপনের জন্য। এটি অভিনব। খ্রিষ্টপূর্বকাল থেকে অতিমারির ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে, থেমে থাকেনি মানুষের জীবনযাপন। অতিমারির বাস্তবতার সমান্তরালে চলেছে জীবনের উৎসব। হ্যাঁ, সেই উৎসবের গতি কখনো কখনো শ্লথ হয়েছে, কিন্তু থেমে যায়নি। থেমে না যাওয়াই মানুষের ইতিহাস, তার বেঁচে থাকার বীরত্বগাথা।

অতিমারির কারণে আমাদের জীবনযাপনে প্রভূত ইতিবাচক ঘটনার প্রবাহ এসেছে। অন্তর্জালের জগতে ঘটেছে সরব বিপ্লব। সেসব উদ্যোগ আমাদের নতুন করে বেঁচে থাকতে সহায়তা করছে অর্থনৈতিকভাবেও। এবার অনেক মানুষ বাসাবাড়িতে বসেই কিনছেন কোরবানির গরু। গত ঈদুল ফিতরের মতো এবারও হবে ভার্চ্যুয়াল আড্ডা, কেনাকাটা। সামনের দিনে যেগুলো আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাবে, সেগুলোর ব্যাপক মহড়া হয়ে গেল আমাদের জীবনে।

ঈদ অর্থ আনন্দ। উৎসবে আনন্দ হবে, জীবনের জয়গান হবে। ভাইরাসের পৃথিবীতে ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক উৎসব হোক আরও নিরাপদ, আরও বর্ণিল।

রজত কান্তি রায়: সাংবাদিক