ভারত ও চীনের টানাটানিতে পড়েছে নেপাল

চলতি বছর মহামারি, বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেপালের ওপর ভারতের সঙ্গে সীমান্তরেখা নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট নেমে এসেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে চলা ঝামেলা ভারত এবং চীনের সঙ্গে নেপালের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শুরুটা হয় গত মে মাসে। ওই মাসের ৮ তারিখে ভারত নেপালের সীমান্ত–সংলগ্ন বিতর্কিত এলাকায় নির্মিত একটি সংযোগ সড়কের উদ্বোধন করে। ওই রাস্তা কৌশলগতভাবে নেপাল ও চীনকে নজরে রাখার জন্য ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নেপালের জনগণের একটি বড় অংশ এর বিরোধিতা করে। আগে থেকেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি প্রবল চাপের মুখে পড়েন। তিনি ঘোষণা দেন, ভারত যে স্থানে রাস্তা তৈরি করেছে, সেটি নেপালের জায়গা। তিনি বলেন, এটি নেপালের সার্বভৌমত্বের ওপর দিল্লির হামলা হিসেবেই তাঁরা দেখছেন। এর পরপরই ওলি ভারতের রাস্তা বানানো এলাকাকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি নেপালের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেন এবং পার্লামেন্ট থেকে তা পাস করিয়ে নেন।

একই সঙ্গে ওলির নেতৃত্বাধীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) নেপালে কোনো বিদেশি নারী কোনো নেপালি ছেলেকে বিয়ে করলে (ভারতের অনেক নারী নেপালি ছেলেদের বিয়ে করে নেপালে থেকে যান) সাত বছর নেপালে একটানা বাস না করলে নাগরিকত্ব পাবেন না মর্মে আইন পাস করেন। এটিও মূলত ভারতকে মাথায় রেখেই করা হয়। ওলির এ পদক্ষেপে নেপালের জাতীয়তাবাদীরা খুবই উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ওলি আসলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই এমন ভারতবিরোধী হতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, নিজের দলের ভেতরের তাঁর প্রতিপক্ষের হাত থেকে বাঁচতেই তিনি এ ঘোষণা দিয়েছেন।

ওলি সরাসরি অভিযোগ করেছেন, দলের মধ্যে যাঁরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁরা ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা করছেন। এমনকি তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও এনসিপিতে ওলির প্রধান প্রতিপক্ষ পুষ্পকমল দহল প্রচন্ড। প্রচন্ড অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি ওলির পদত্যাগ চান, ভারত নয়। এনসিপির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নেপালের এই রাজনৈতিক সংকটের একটি বড় কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো নেপালে প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে ভারত ও চীনের টানাটানি।

ভারতের সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে অভিযোগ করেছেন, চীনের উসকানিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী ওলি ভারতের রাস্তা নির্মাণের বিরোধিতা করেছেন। ভারতের বিজেপিপন্থী সংবাদমাধ্যমগুলোও ওলিকে আক্রমণ করে বিভিন্ন খবরাখবর প্রচার করেছে। তারা বলছে, নেপালে চীনের নিযুক্ত দূত হৌ ইয়াংকির অঙ্গুলিনির্দেশেই ওলির সরকার চলছে। অবশ্য এ বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রমাণ কেউ এখনো দেখাতে পারেনি। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা, ওলিকে চীন সমর্থন করছে এবং প্রচন্ডকে ভারত সমর্থন দিচ্ছে। এর আগে ভারত নেপালের সরকার পরিবর্তনে সরাসরি ভূমিকা রাখায় ভারতের বিরুদ্ধে ওলি যে অভিযোগ তুলেছেন, তা কেউ উড়িয়ে দিতে পারছে না।

২০১৮ সালে প্রচন্ডর নেতৃত্বাধীন মাওবাদী দল ও নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়। এই সময় চুক্তি হয় ওলি এবং প্রচন্ড দুজনই এনসিপির চেয়ারম্যান থাকবেন। পাঁচ বছর পরপর পালা করে তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। সেই হিসেবে ওলির প্রধানমন্ত্রিত্বের অর্ধেক সময় কেটে গেছে। গত নভেম্বরে আবার একটি প্রস্তাব ওঠে। তাতে বলা হয়, দলের একমাত্র চেয়ারম্যান হবেন প্রচন্ড এবং ওলির হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব থাকবে। কিন্তু ওলি সে প্রস্তাব মানেননি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

ভারত প্রচন্ডকে অস্ত্র বানিয়ে ওলিকে ক্ষমতা থেকে নামানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে ওলি ভারতের কোপানল থেকে বাঁচতে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ওলি যতক্ষণ প্রধানমন্ত্রী থাকছেন, ততক্ষণ নেপালে চীনের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকছে এবং ভারত কোণঠাসা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রচন্ড প্রধানমন্ত্রী হলে ভারত উপকৃত হবে এবং চীনের মিশন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে চীন ও ভারতের টানাটানির মাঝখানে পড়ে গেছে নেপাল।

এ অবস্থায় নেপালের রাজনীতি নেপালের হাতে কতটুকু আছে, তা ভাবার বিষয়।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
আরিফ রফিক: ওয়াশিংটন ডিসির মিডলইস্ট ইনস্টিটিউটের ফেলো