শুধু না আর না

আবুল হায়াত
আবুল হায়াত

দেশটা হঠাৎ করে যেন ‘না’তে ডুবে গেছে। প্রথমেই ধরুন করোনা। এই ভাইরাস হানা দেওয়ার পর থেকে মানুষ সমস্বরে করছে প্রার্থনা: আল্লাহ, তুমি করো একটু করুণা।

এরপর বের হলো ঘটনা। না, অন্য কিছু না, প্রতারণা। করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে সাংঘাতিক প্রতারণা। সর্বশেষ এল ‘বোননা’ (বন্যা)। আসতে থাকল নানা রকমের সরকারি নির্দেশনা। জনগণ তো বাঘের বাচ্চা, তারা বলে মানি না, মানব না। মাস্ক পরব না, হাত ধোব না, সামাজিক দূরত্ব মানব না। করোনা টেস্ট করাব না। টেস্ট করে পজিটিভ হলে বলব না।

হাসপাতালে যাব না।
কেন? হাসপাতালে কেন যাবেন না, ভাই?
আমাকে পজিটিভ দেখিয়ে জোর করে ভর্তি করে নেবে।
হ্যাঁ, হাসপাতাল সম্পর্কে এমন অভিযোগ শোনা গেছে। তাই বলে সবাই তো আর এই দোষে দোষী নয়।
তা মানলাম, কিন্তু আমি যদি নেগেটিভ থাকি, ওখানে গিয়েও তো সংক্রমিত হতে পারি! দরকার কী ভাই? নানা টোটকা আছে, একটা এস্তেমাল করব, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
হাসপাতাল নিয়ে এত অনীহ কেন মানুষের?

হাসপাতাল তো সৃষ্টি হয়েছিল অসুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য। যুগ যুগ ধরে এই কাজই করে এসেছে হাসপাতাল। প্রথম এই ধারণা এসেছিল গ্রিস থেকে। রোমান সম্রাটদের আমলে ছিল এই ধরনের ব্যবস্থা, এমনকি ভারতবর্ষেও প্রাচীনকালে রোগীদের চিকিৎসাসেবার জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল বলে শোনা যায়। তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রথাগত হাসপাতাল স্থাপনের হদিস পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে বাগদাদে জেনারেল হাসপাতাল এ পর্যন্ত জানা সর্বপ্রথম সরকারিভাবে স্থাপিত হাসপাতাল। চীনও এ ব্যাপারে অনেকটা অগ্রগামী। তবে ১৪ শতক থেকে আধুনিক হাসপাতালের উদ্ভব ঘটে বলে অনেকের ধারণা।

হাসপাতাল, যার ইংরেজি হচ্ছে Hospital,এটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ Hospes থেকে। এর অর্থ অতিথিশালা, যেখানে অতিথিদের থাকা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। এই শব্দটিই কেন চিকিৎসাকেন্দ্রের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, তা বলা কঠিন। তবে এটা সত্য যে যাঁরা হাসপাতাল স্থাপন করেছিলেন, তাঁরা তা করেছিলেন মহৎ উদ্দেশ্যেই। চিকিৎসকেরা হিপোক্রেটিক শপথ নিয়ে অন্তর দিয়ে আর্তমানবতার সেবা করেছেন। আমার বিশ্বাস, তাঁরা এখনো তাই করছেন। তবে গোলটা বাধল চিকিৎসাসেবাকে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে পরিণত করার পর থেকে। মুনাফা বা লাভই যখন প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠল, তখন সেবার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ল। কারণ, লাভের প্রশ্ন সামনে এলেই লোভের ব্যাপারটা চলে আসে। মুনাফার লোভেই রোগীর সেবাটা অনেকখানি গৌণ হয়ে যায়।

এই কঠিন ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ নাহয় আর না করলাম। তার চেয়ে চলুন, আসছে কোরবানির ঈদের আনন্দে কয়েকটা চুটকি বলি। আর সেটা এই হাসপাতাল আর চিকিৎসা নিয়েই হয়ে যাক না।

যখন ক্লোরোফর্ম আবিষ্কৃত হয়নি, তখন রোগীকে অজ্ঞান করা হতো কীভাবে জানেন তো?
মাথার পেছনে আঘাত করে।
এক্স–রে আবিষ্কারের আগে ডাক্তার কী করে রোগীর ভেতরটা দেখতেন?
রোগীকে লাইটের সামনে ধরতেন।
রোগী: আমাকে কি এখন অ্যানেসথেশিয়া দেওয়া হবে?
ডাক্তার: জি হ্যাঁ, লোকাল অ্যানেসথেশিয়া।
রোগী: প্লিজ, না! আমাকে ফরেন অ্যানেসথেশিয়া দেন।
...
হাসপাতাল ম্যানেজার: স্যার, ১১২ নম্বর কেবিনের পেশেন্টের অপারেশনটা খুব সময়মতো করা হয়েছে।
হাসপাতাল মালিক: কী রকম?
হাসপাতাল ম্যানেজার: আর আধঘণ্টা দেরি হলেই রোগী সুস্থ হয়ে যেত।
শেষ করি এক মরণাপন্ন রোগীর গল্প দিয়ে, যদিও আগেই বলা এটা।
এক রোগীর মরণশ্বাস উঠেছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু ইশারায় কিছু বলতে পারেন। তওবা পড়ানোর জন্য একজনকে ডাকা হয়েছে। তিনি আসবার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর শ্বাসকষ্ট চরমে উঠে গেল। তিনি হাত নেড়ে অস্থির হয়ে কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। কাগজ–কলম দেওয়া হলো রোগীর হাতে। রোগী তাতে কিছু লিখে যিনি তওবা পড়াচ্ছিলেন, তাঁর হাতে দিলেন। তিনি কাগজটা না পড়ে ভাঁজ করে নিজের পকেটে রেখে দিলেন। তারপর রোগীকে বললেন: পরে পড়ব। আগে আসুন, কাজটা শেষ করে নিই।

তওবা পড়তে পড়তে রোগীর মৃত্যু হলো। কাজ শেষে তিনি কাগজটা বের করে সবাইকে পড়ে শোনালেন: ‘আপনি আমার অক্সিজেন পাইপের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন।’

আজ এই করোনাকালে যাঁরা আমাদের অক্সিজেন পাইপের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা কি একটু সরে দাঁড়াবেন? আমাদের যে শ্বাসকষ্ট উঠেছে আজ!

শেষের পরও ‘না’ দিয়েই শেষ কথাটা বলি। বাঙালি জাতি অদম্য। সবকিছু সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সদাসর্বদা প্রস্তুত। করোনাভাইরাসকে আমরা ভয় করব না। করব জয়। তার আগে কিন্তু অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ ও নিয়মভঙ্গকে ‘না’ বলতে হবে।
‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।।’
ঈদ মোবারক।

আবুল হায়াত অভিনেতা: নাগরিক সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য