করোনা কতটা পজিটিভ

‘ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন’ করোনাকালীন বহুল প্রচারিত প্রতিপাদ্য। কয়েক মাস ধরে এ প্রতিপাদ্য বাধ্য হয়েই মানুষ মেনে চলছেন। যাঁদের ঘরে বসে থাকলে পেট চলে না, তাঁদের নীতিকথা মানার কোনো উপায় নেই। মুখোশই তাঁদের একমাত্র নিরাপত্তাকবচ। এর বাইরে যাঁরা ঘরে থাকছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সচ্ছল। কোনো কোনো পরিবারে পুরুষ উপার্জনক্ষম, কোনো পরিবারে নারী-পুরুষ দুজনেই। আমাদের প্রচলিত সমাজকাঠামোয় নারী ঘরের বাইরে কাজ করলেও ঘরে ফিরে তাঁকেই গৃহস্থালি সামলাতে হয়, সেবামূলক কাজ করতে হয় এবং সামাজিকতা রক্ষার মূল দায়িত্ব পালন করতে হয়।

করোনা–পূর্ব সময়ে বিশেষ করে রোজগেরে নারীরা গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, মুক্ত আলোচনা ইত্যাদিতে জেন্ডার শ্রম বিভাজনের কুফল নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। নারীর প্রতি অন্যান্য বৈষম্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি চিত্র এটি। করোনাকালীন গৃহবন্দিত্বে নারীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন এই ভেবে যে এ ক্রান্তিলগ্নে গৃহকর্মে পুরুষের অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হবে। দুঃখের বিষয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়নি। 

ঘরের বাইরে কাজ করা নারীর স্বামী এ সময়ে বরং খানিকটা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন যে স্ত্রী এখন অঢেল সময় পাবেন হরেক পদের রান্না করে খাওয়ানোর। চাকুরে বউয়ের জ্বালায় পেটে একেবারে চড়া পড়ে গিয়েছিল! হোস্টেল থেকে সন্তানেরা বাসায় ফিরেছে। তারা একটু বাইরে ঘুরে এসেই কাপড় ছেড়ে রেখে গোসল সেরে বেরোচ্ছে। ভারী ভারী জিনস ধুতে গিয়ে মা–বোনদের কোমরের বারোটা বাজছে। কারণ, করোনায় অস্থায়ী গৃহকর্মীরা আর আসতে পারেন না। প্রথম দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো পরিবারে বেড়াতে আসা অতিথিরা দীর্ঘদিন অবস্থান করে গেছেন। সব ঝক্কি সামলাতে হয়েছে নারীকে।

কর্মজীবী পুরুষ অফিসে না গিয়েও ঘরে বসে অনলাইনে ডিজিটাল পারদর্শিতা প্রদর্শন করছেন। গৃহবধূ নারীর অনেকেই এসব বোঝেন না। ভয় পান। তাঁরা ওভেন, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডারে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু পুরুষেরা এখনো এগুলোকে নারীর কাজের জিনিস ভেবে তা ব্যবহার করতে শরম বোধ করেন। অথচ কর্ম–উদ্যোগী নারী কত সহজেই অনলাইনে অফিস চালাচ্ছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করে চলেছেন।

করোনা ঘরের কাজে পুরুষের জন্য কতটা পজিটিভ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারল জানি না, কিন্তু নারী তাঁর স্বভাবজাত প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। ওপার বাংলার একজন স্বনামধন্য নারী সংগীতশিল্পী অনলাইনে দেশীয় সিল্কের শাড়ি বিক্রি করছেন, আমাদের দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক ভেজিটেবল ডাই পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন অনলাইনে। অসংখ্য ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা করোনাকে ইতিবাচক হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন।

অথচ গৃহবন্দিত্বের এ সময়ে নারী চেয়েছিলেন গৃহকর্মে বাড়ির পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ, কেবল সহযোগিতা নয়। কারণ, সংসারটা নারীর একার নয়। অনেক উদার পুরুষ ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করছেন, এ কথা প্রচার করে বাহবা কুড়াতে চান। যেন কাজটা নারীর, তিনি এটা–ওটা এগিয়ে দিয়ে নারীকে কৃতার্থ করেছেন।

অপ্রত্যাশিত সামাজিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক বা যুদ্ধকালে সময়ের দাবিতে মানুষের ভেতর কিছু মানবিক গুণের জন্ম হয়। মহামারির কালকে কাজে লাগিয়ে অনাদিকালীন পারিবারিক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূলে কুঠারাঘাত করে মানবিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল। একেবারে যে হয়নি তা নয়, কিন্তু তা যতটা না স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের, তার চেয়ে বেশি কৌতুক উদ্রেককারী। এই সুযোগে সচেতন মা-বাবারা ছেলেসন্তানদের ঘরোয়া কাজ শেখানোর প্রশিক্ষণ দিতে পারতেন। শুধু ছেলেশিশু কেন, মা ঘরে থাকলে মেয়েরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকে। আর কবে শেষ হবে নারীর একার লড়াই? কবে নারীকে বন্ধু, সহযোদ্ধা, সতীর্থ হিসেবে পাশে নেবে পুরুষ? গৃহবন্দিত্বের এ দিনগুলোতে খোলা জানালা দিয়ে অন্তত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের অবাধ হাওয়া এসে খেলা করুক গৃহাভ্যন্তরে।

উম্মে মুসলিমা লেখক
[email protected]