দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক প্রয়োগের প্রেক্ষাপটে এ আইনের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে আবারও জোর আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে আইনটি জারির হওয়ার আগেই আইনটির বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমগুলো যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, তার থেকে ভিন্ন কিছু হয়নি। গত মে মাসে সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দমনের অস্ত্র হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহারের শঙ্কা ‘এখন গণমাধ্যমের জন্য দুঃস্বপ্নের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে’।

আসলে এই দুঃস্বপ্নের সূচনা হয়েছিল এই আইনের খসড়া তৈরি থেকেই। তবে এটাও ঠিক, মার্চ মাসে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হলে এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সরকার ও তার সমর্থকদের অপছন্দ হলে জামিন–অযোগ্য ধারায় মামলা হচ্ছে, পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করছে। অনেক ক্ষেত্রেই আটকের পরে এই ধারায় মামলা করা হচ্ছে। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সাদাপোশাকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।

এই আইনের কতটা ব্যাপক প্রয়োগ হচ্ছে, তা বোঝা যায় আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল ১৯-এর সংগ্রহ করা তথ্যে। তাদের হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এই আইনে মামলা হয়েছে ১১১টি, অভিযুক্ত হয়েছেন কমপক্ষে ২০৫ জন, আটক হয়েছেন ১১১ জন। আরেকটি হিসাবে বলা হচ্ছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এখন প্রতিদিন গড়ে তিনটি করে মামলা হচ্ছে’ (প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০২০)। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন জামিন পেয়েছেন, তার পুরো হিসাব নেই।

এই আইনের ২০টি ধারার ১৪টিই অজামিনযোগ্য; ফলে মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও কারাগারে প্রেরণের ঘটনা ঘটে দ্রুত। ক্ষেত্রবিশেষে এত দ্রুত যে তাতে এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, এই দেশেই পুলিশ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত এমন একজন ব্যক্তিকে ১০ বছর খুঁজেই পায়নি, যিনি বঙ্গভবনে গেছেন, ক্ষমতাসীন দলের সভায় থেকেছেন, সরকারের সঙ্গে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে চুক্তি করেছেন এবং নিয়মিতভাবে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।

এই আইনের পূর্বসূরি ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬, যা ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। ২০০৬ সালে এই আইনের প্রবর্তন হলেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই আইনে মামলার কথা তেমনভাবে শোনা যায়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এই আইনের সংশোধনের মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে ৫৭ ধারায় শাস্তি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে, ভিন্নমত দমনের সহজ পথ খুলে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও এই আইনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকেরা, যার মধ্যে সাংবাদিকেরাও আছেন, নানা যুক্তি দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আইসিটি আইন বাতিল করে আরও ভয়াবহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ চালু করা হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে যাঁরা আইসিটি আইনের আওতায় অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের বিচার অব্যাহত আছে। 

২০১৬ সালে আইসিটি আইন নিয়ে প্রবল বিতর্কের মুখে জানা যায়, সে পর্যন্ত ৯৪ শতাংশ মামলা হয়েছে বিতর্কিত ৫৭ ধারায়। ‘আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬৬ শতাংশ মামলারই সব আসামি খালাস পেয়েছেন। তার মানে, মাত্র ৩৪ শতাংশ মামলা প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত পর্যায়েই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে ১৩ শতাংশ মামলা। পুলিশ সেগুলোর বিষয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।’ জানা যায়, ‘তদন্তে ঘটনার সত্যতা না পেয়ে গত তিন বছরে ৪৬টি মামলায় পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে’ (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬)। 

পরের হিসাবে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪১৭টি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ মামলা হয়েছিল ৫৭ ধারায়। এই সব তথ্যেই এটা স্পষ্ট ছিল যে এই ধরনের আইনের কথিত অপব্যবহার অনিবার্য। তারপরেও ক্ষমতাসীনেরা মনে করেছেন, তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা দরকার; তার পরিণতি হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। সরাসরি মতপ্রকাশের কারণে ওই বছরে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ৩৭টি এবং নতুন আইনে হয় ৩৪টি; ২০১৯ সালে নতুন আইনে ৬৩টি। এরপর থেকে জোয়ারের মতো মামলা হচ্ছে, আটক হচ্ছে, কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।

এই আইন নিয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই আলোচনা হয়েছে; আদালতে রিট হয়েছে, সাংবাদিকেরা প্রতিবাদ করেছেন, সম্পাদক পরিষদও মানববন্ধন করেছে। সরকার গোড়াতে এর ‘অপপ্রয়োগ হবে না’ বলে আশ্বাস দিত, এখন তা–ও করেন না। আটকের ঘটনা ঘটছেই, এর শিকার হয়েছে ১৫ বছরের কিশোরও। পাশাপাশি তিনটি বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে, যা সহজে দৃশ্যমান না হলেও তার গুরুত্ব আটকের সংখ্যার চেয়ে কম নয়, সম্ভবত বেশি।

প্রথমত, এই আইনের ফলে গোটা ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা বড় ধরনের বিপদের মুখে পড়েছে। এই আইনের কারণে রাজনৈতিক বিবেচনাকে আইনিভাবেই প্রাধান্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়োগ ও তাঁদের আচরণ থেকে এ কথা বলা হয়ে থাকে যে এই ব্যবস্থার দলীয়করণ হয়েছে। সেই দলীয়করণের বিষয়টি হচ্ছে আইনের বাইরে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এমন সব ধারা আছে, যেখানে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিকল্প নেই। এই রকম একটি ধারা ২১ নম্বর ধারা; এতে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাখ্যা কে কীভাবে করবেন, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু কেউ যদি এই বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে থানায় উপস্থিত হন, তবে কি থানার কর্মকর্তার পক্ষে এটা বলা সম্ভব যে তাঁর কাছে এই অভিযোগের মেরিট বা মামলার যোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না? তদুপরি অভিযোগকারী যদি ক্ষমতাসীন দলের নেতা হন, সে ক্ষেত্রে মামলার যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য পাবে। আদালতের প্রসঙ্গ না হয় আলোচনার বাইরেই থাকল।

দ্বিতীয়ত, এই আইনের ফলে একধরনের বিচারের ব্যবস্থা হয়েছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ভিজিলান্টি জাস্টিস। এর অর্থ, যাদের হাতে আইনের ব্যাখ্যার বা বিচারের দায়িত্ব নেই, তারাই কার্যত বিচার করছে। একে বাংলায় গুন্ডাপান্ডার বিচার বলা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো কারণে কেউ যদি ক্ষুব্ধ না–ও হন, তাঁকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে অন্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, তাঁকে হয়রানি করা যায়। এই আইনে যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারেন যে তিনি তৃতীয় কারও সম্মানহানিতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। 

গত ছয় মাসে যত মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ২৭টি মামলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে এবং ১৪টি হয়েছে সংসদ সদস্যদের অবমাননার জন্য। অধিকাংশ মামলা করেছেন দলের কর্মীরা। একই ধরনের ঘটনা আছে অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রেও। এগুলোর প্রত্যক্ষ ফল হচ্ছে সাধারণ নাগরিকেরা যেকোনো ধরনের বিষয়ে মন্তব্য করা থেকেই বিরত থাকেন। এগুলো একধরনের সেন্সরশিপ। আইন করে রাষ্ট্র বা সরকারকে সেন্সর করতে হচ্ছে না; একদিকে তৈরি হচ্ছে সেলফ-সেন্সরশিপ, অন্যদিকে এই নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিরাই একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি চালু করতে পেরেছে।

তৃতীয়ত, এই আইনের পরিধির ব্যাপকতার কারণে গবেষণার ওপরে প্রভাব। আইনটি প্রণয়নের প্রস্তাবের পর থেকেই গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ওপরে তার প্রভাব, সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর একটি বড় প্রভাব পড়ছে সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রেও। এই আইনের বিভিন্ন ধারা, বিশেষ করে ২১ ধারা যেভাবে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা ও স্বাধীন গবেষণার ওপরে একধরনের বাধানিষেধ তৈরি করেছে, তার প্রভাব ভবিষ্যতে আরও বেশি প্রত্যক্ষ হবে। অনেকেই বলবেন, গবেষণার কারণে এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়নি। কিন্তু এই আইনের বিবেচনায় কেউ তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে ‘সাবধানতা’ অবলম্বন করছেন কি না, তা জানার উপায় নেই। কতজন আটক হলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সংখ্যাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে দেশের একাডেমিকদের যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিল, দুঃখজনকভাবে তা দৃশ্যমান নয়। তাঁরা কি এ নিয়ে কথা বলতেই ভয় পাচ্ছেন?

জারি হওয়ার দুই বছরের কম সময়ের মধ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, এই আইন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়, দেশে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মতপ্রকাশের অধিকার হরণ প্রক্রিয়ারই একটি অংশ।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর