'আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক'

কয়েক দিন আগের কথা। ছুটির সকালে ঘুম ভাঙল একটি শোক সংবাদের ঘোষণা শুনে। মৃত্যুসংবাদটি একজন নারীর। সম্ভবত আশপাশের কোনো এক বাসায় থাকতেন তিনি। তবে কে মারা গেছেন, তা বুঝতে মন দিয়ে ধৈর্য নিয়ে শুনতে হলো ঘোষণাটি। কারণ, সদ্য মৃত নারীর নাম উল্লেখ করার আগে তাঁর স্বামীর নাম, পেশা, রাজনৈতিক পরিচয়, তিনি কোন কোন কমিটির সঙ্গে যুক্ত আছেন ইত্যাদির এত লম্বা ফিরিস্তি ছিল যে সেসব পেরিয়ে ঘোষণার মূল বিষয়বস্তুতে আসতে ধৈর্যচ্যুতি হওয়ার উপক্রম হয়। বুঝলাম, নারীটির স্বামী হয়তো বিশিষ্ট কেউ হবেন। দুর্ভাগ্য, সদ্য মৃত নারীটির নাম গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁর স্বামীর নাম, যশ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি। অথচ ঘোষণাটির প্রথমেই বলা যেতে পারত নারীটির নাম। এরপর যুক্ত করা যেত স্বামীর নাম, পরিচয় ইত্যাদি। 

হয়তো স্বামীর পরিচিতির সূত্র ধরেই অনেকে অংশ নেবেন জানাজায়। কিন্তু তারপরও মৃত্যুসংবাদ উপস্থাপনের এই দিকটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। আমি জানি না ওই নারী কী করতেন; তিনি কি শুধু গৃহব্যবস্থাপনাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, নাকি এর বাইরেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল! স্বামীর নাম–পরিচয়ের আড়ালে দেওয়ার মতো স্বকীয় কোনো পরিচয় তাঁর ছিল কি না! 

কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ একটি যুগ পাড়ি দিয়েছি আমি। কর্মক্ষেত্রের বাইরেও নানান পরিসরে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাস্তবতা এই, আমরা যে সমাজে বসবাস করি, সেখানে বসবাসকারী অধিকাংশই নারীর নিজস্ব পরিচয়ের তোয়াক্কা করেন না। বাস্তব জীবনের ছোটখাটো অভিজ্ঞতাগুলো বারবারই আমাকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত, আমার এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেক নারীই তাঁদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পাবেন। এই যেমন করোনা লকডাউনে প্রায়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য ফোন করতে হয় পাশের মুদিদোকানিকে। যতবারই ফোন দিয়ে দিয়ে আমি তাঁকে নিজের নামটি বলি, উনি কিছুতেই আমাকে স্মরণ করতে পারেন না। অথচ স্বামীর পরিচয় দেওয়ামাত্রই উনি আমাকে চিনতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন। অথচ রোজকার দিনগুলোতে অফিস থেকে ফেরার পথে ওনার দোকানে আমারই যাতায়াত বেশি। আশ্চর্য, উনি আমার নামটি মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন না! 

অন্যদিকে একই বাড়িতে দীর্ঘ আট বছর বসবাস করলেও বাড়ির কেয়ারটেকাররা আমার নামের সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত নন। অথচ হরহামেশাই আমার নামে প্রয়োজনীয় চিঠি, ডেলিভারি আসছে, দাপ্তরিক প্রয়োজনে আসছে অফিসের গাড়ি। স্বামী, সন্তানের নাম কিংবা ফ্ল্যাটের নম্বর ছাড়া আমি যেন অচেনা কেউ। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্রটিও আমার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। ওর মা হিসেবে আমার যতখানি পরিচিতি আছে, আমার নিজের সেই পরিচিতিটুকুও নেই। 

কন্যাশিশুর নাম রাখার সময় মূল নামের শেষে অনেক ক্ষেত্রেই বাবার নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়। বিয়ের আগে বাবার এবং বিয়ের পরে স্বামীর নামের অংশটি নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতাটি মূলত ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ। আমাদের সংস্কৃতি একসময় এই প্রবণতা দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে। প্রভাবশালী অনেক নারীও সেই ধারায় গা ভাসিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, আমলাসহ অনেকেই। পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে আগত বলে এই ধারাকে অনেকেই প্রগতিশীলতার মানদণ্ড জ্ঞান করেছেন। বর্তমানে এই প্রবণতা কিছুটা কমলেও এ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি আমরা। একটি দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক, কোনো কন্যাশিশুর নাম রাখা হলো ‘রেবেকা হাসান’। এই হাসান নামটি হয়তো পৈতৃক সূত্রে রেবেকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে তাঁর সঙ্গে রফিক নামের কারও হয়তো বিয়ে হলো। অমনি তিনি হয়ে গেলেন ‘রেবেকা রফিক’। কালের পরিক্রমায় একসময় রেবেকা নামটিই বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। তিনি হয়ে যান শুধুই ‘মিসেস রফিক’। কোনো বিয়েতে আমন্ত্রিত হলে আমন্ত্রণপত্রের ওপরে মোটা হরফে লেখা থাকে ‘মিঃ অ্যান্ড মিসেস রফিক’। এবার ধরা যাক, ‘আয়েশা আক্তার’ নামের কেউ হয়তো কোনো এক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কাজ করেন। হয়তো তাঁর কোন এক সহকর্মীর বিয়েতে তিনি সপরিবার আমন্ত্রিত হয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আমন্ত্রণপত্রের ওপরে ‘মি. অ্যান্ড মিসেস আক্তার’ লেখার বিষয়টি কিন্তু স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা হবে না। তাই আমন্ত্রণ জানানোর আগেই আয়েশা আক্তারের স্বামীর নামটি সংগ্রহ করবেন সংশ্লিষ্টরা। আবার ‘আয়েশা আক্তার ও পরিবার’ এভাবে লিখতেও অনেকে কুণ্ঠা বোধ করেন। কারণ, তাতে আয়েশা আক্তারের স্বামী অস্বস্তিবোধ করতে পারেন। অথচ নারীদের অস্বস্তির জায়গাগুলোকে যুগের পর যুগ বিবেচনাতেই আনা হয় না। আর এই বিষয়গুলো এত প্রকটভাবে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে যে এসব বৈষম্যের ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই নির্বিকার থাকি। এমনকি অনেক নারীও বিষয়গুলো তলিয়ে দেখেন না। 

পুরুষের পরিচয়ের ছায়ায় নারী অনেক ক্ষেত্রেই নিজেকে মেলে ধরতে পারেন না। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা হাতে রাখার রাজনীতির মারপ্যাঁচ। নারী সে যতই যোগ্য হোক না কেন, সে থাকবে পুরুষের অধীন তার সম্পত্তি হয়ে। তাই ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগপর্যন্ত মাতৃগর্ভে যে কন্যাশিশুর বেড়ে ওঠা, জন্মগ্রহণ করামাত্রই সে পরিচিত লাভ করে বাবার পরিচয়ে আর বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে। সর্বক্ষেত্রে মাতার পরিচয়কে আমরা আজও নিশ্চিত করতে পারিনি। এমনকি মৃত্যুর পরও মৃত নারীর নামফলকে তাঁর নামের সঙ্গে লেখা থাকে স্বামীর নাম। নারীটি যদি অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান, সে ক্ষেত্রে লেখা থাকে বাবার নাম। এভাবেই পুরুষের পরিচয়ের ছায়ায় আবর্তিত হয় নারীর জীবন-মরণ। মনে রাখা প্রয়োজন, পিতৃতান্ত্রিক পরিচয়ের এই ভার নারীর স্বকীয় বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক