ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের গিলে খাওয়ার আর কতটা বাকি

পশ্চিম তীরের দখল করা এলাকায় ইসরায়েলি ইহুদিদের বসতি। ফাইল ছবি। রয়টার্স
পশ্চিম তীরের দখল করা এলাকায় ইসরায়েলি ইহুদিদের বসতি। ফাইল ছবি। রয়টার্স

করোনা মহামারির বিস্তার ও ফিলিস্তিনিদের চলাচলের ওপর ইসরায়েলের উত্তরোত্তর বেড়ে চলা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মাঝে মাঝে কিছু ফিলিস্তিনি বন্ধুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করার সুযোগ হয়। মাঝেমধ্যে আমার মোবাইল ফোনে অনেক সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও বন্ধুরা পশ্চিম তীর থেকে আমাকে করোনা ও ইসরায়েলের দখলদারির হালনাগাদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। আমি একটার পর একটা মেসেজ পড়ি আর ক্রমাগত বিমর্ষ হতে থাকি। 

ফিলিস্তিনিদের কপালে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু ইসরায়েলের আগ্রাসন সম্প্রতি এতটাই বেড়েছে যে আমরা এখন একজন আরেকজনকে হরহামেশাই জিজ্ঞাসা করছি, ‘সামনে যে পরিস্থিতি আসছে, তাতে আমরা টিকে থাকতে পারব বলে কি তুমি মনে করো?’

আমরা ফিলিস্তিনিরা অন্তত এটুকু জানি, আমাদের অনেকেই টিকে থাকতে পারব না। আমাদের প্রতি মুহূর্তে ইসরায়েল তা মনে করিয়ে দিচ্ছে। গত জুনে বেথলেহেমের কাছে ইসরায়েলি চেকপয়েন্টে একেবারে তরুণ বয়সী আহমেদ এরাকাতকে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে মেরে ফেলল। এর দুই সপ্তাহ পরে ২৯ বছর বয়সী ইব্রাহিম আবু ইয়াকুবকে পশ্চিম তীরের সালফিত এলাকায় সেনারা গুলি করে মারল। গোটা ফিলিস্তিনে এমন ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে যে আমরা কেউই আর নিরাপদ বোধ করতে পারছি না। 

অতি সম্প্রতি ইসরায়েল পশ্চিম তীরে যেভাবে ঝড়ের গতিতে দখলদারি শুরু করেছে, ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় যেভাবে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে ফিলিস্তিনিরা কত দিন পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে, সেটাই তাদের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের জমি দখল করার জন্য আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানানোর বহু আগে থেকেই দখলদারি চলে আসছে। কিন্তু আগে জমি দখল করতে কিছুটা হলেও রাখঢাক করা হতো। কিন্তু এখন আর তা হয় না। ইহুদি বসতি এত দ্রুত গড়ে তোলা হয় যে রাতারাতি বাড়ি তুলে ফেলা হয়। তারা অগ্রসর হতে হতে এখন আমাদের গ্রাম-শহর—সবখানে ঢুকে পড়ছে। আমার এক বন্ধু জেরুজালেমে থাকেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘পশ্চিম তীরে যে বসতি বানানো হচ্ছে, তার ধরন মোটেও অস্থায়ী বসতির মতো নয়।’ 

পশ্চিম তীরের ভেতরেই ইসরায়েলি সেনারা যখন যেখানে খুশি চেকপয়েন্ট বসাচ্ছে। রামাল্লা থেকে বেথলেহেমের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। এটি গাড়িতে গেলে কয়েক মিনিটের পথ। কিন্তু এসব চেকপয়েন্টের কারণে এইটুকু পথ পাড়ি দিতে ফিলিস্তিনিদের কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। 

এর বাইরে আছে স্থায়ী চেকপয়েন্ট। এর একটি হলো কুখ্যাত কালান্দিয়া চেকপয়েন্ট। এটি জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরকে আলাদা করেছে। এই চেকপয়েন্ট পার হতে গেলে একজন ফিলিস্তিনি নাগরিককে যে প্রক্রিয়ায় তল্লাশি চালানো হয়, তা আধুনিক বিমানবন্দরেও হয় না। ইলেকট্রনিক ডোর, নজরদারি ক্যামেরা তো আছেই। সেখানে সর্বক্ষণ ইসরায়েলি সেনারা বসে থাকেন। কাচের জানালার ওপাশ থেকে তাঁরা হুকুম দেন, ‘সামনে যান, দাঁড়ান, আপনি যেতে পারবেন, আপনি যেতে পারবেন না, আপনাকে আরও তল্লাশি করতে হবে।’ 

অ্যালেনবি সেতু দিয়ে একসময় ফিলিস্তিনিরা সহজেই জর্ডানে যেতে পারতেন। এই সেতুকে আপত্কালীন বহির্গমন বলা হতো। সেটি এখন ইসরায়েলিরা কবজায় নিয়েছে। কে যেতে পারবেন আর কে পারবেন না, তা তাঁরাই ঠিক করেন। 

পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাঁরা গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কারণ, গাজায় ইহুদি বসতি নেই, সে কারণে সেখানে ইসরায়েল নির্বিচার বোমা বর্ষণ করতে পারে। সে বোমায় যেহেতু ইহুদিদের মরার ঝুঁকি নেই, সেহেতু বোমা ফেলতে কোনো বাছবিচার করা হয় না। কিন্তু পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের মধ্যেই ইহুদিরা এখন এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে সেখানে ফিলিস্তিনিদের দমন করতে বোমা ফেলা কঠিন। এতে ইহুদিদের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মনে করে এখানে বিমান হামলা চালানো হয় না। ইসরায়েলের নাগরিকত্ব আছে এমন ফিলিস্তিনিরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাঁদের সার্বক্ষণিক গতিবিধি নজরে রাখা হয়। 

ইসরায়েল বছরের পর বছর এমনভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করেছে এবং সেখানকার সংস্কৃতিকে ‘ইসরায়েলিকরণ’ করেছে যে দখলকৃত ভূমি যে ফিলিস্তিনের তা খোদ ফিলিস্তিনিরাই ভুলে গেছে। যেমন ইয়াফ্ফা, সাফাদ ও হাইফা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড ছিল। কিন্তু এখন বলা যায় কোনো ফিলিস্তিনিই ভাবতে পারে না যে এগুলো তাদেরই শহর। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন যেভাবে পশ্চিম তীর দখল করার অভিযান চালাচ্ছেন, তাতে গোটা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে ইসরায়েলের মানচিত্র গিলে খাবে—এমন আশঙ্কা করা অমূলক নয়। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

মরিয়ম বারঘুতি ফিলিস্তিনের বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক