অপরাধ দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যা আর নয়

দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে প্রায় দেড় দশক ধরে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তা নিয়ে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধের কথা কেউ কখনো শোনেনি। এমনকি, সংসদে সরকার মনোনীত বিরোধী দলও বিচারবহির্ভূত হত্যার নীতিকে সমর্থন জানিয়ে কখনো ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তদের, কখনো সন্দেহজনক মাদক কারবারিদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। 

এ ধরনের নীতি যে অঘোষিতভাবে চালু আছে, ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দু-একজনের মুখ থেকে সংসদে তার স্বীকারোক্তিও মিলেছে। এমন পটভূমিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদখানের মৃত্যু এবং তাঁকে কেন্দ্র করে পুলিশের অবিশ্বাস্য ভাষ্য নিয়ে যে ক্ষোভ ও গুঞ্জন শুরু হয়েছে, তা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিতর্ককে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে।

এই বিতর্কের আলোড়ন এতটাই তীব্র যে সেনাপ্রধান এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক সম্ভবত এই প্রথম যৌথভাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেন। সেখানে তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘এ ঘটনায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ এমন কোনো আচরণ করবে না, যার মাধ্যমে দুই বাহিনীর সম্পর্কে চিড় ধরে।’ সেনাপ্রধান এবং পুলিশপ্রধানও আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের প্রতি তাঁরা আস্থাশীল এবং ‘তদন্তে কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে তার জন্য ব্যক্তিই দায়ী থাকবেন, প্রতিষ্ঠান দায় নেবে না।’ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী মর্মাহত জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’

সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থল দেখতে গেছেন এবং সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। যেকোনো ধরনের উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টাই ইতিবাচক এবং তার জন্য তাঁরা প্রশংসার দাবিদার। তবে, উত্তেজনা নিরসনের এটাই সেরা পন্থা কি না, তা নিয়ে যে প্রশ্নের অবকাশ নেই, সে কথা বলা যাবে না। তাঁদের এই নতুন নজির তৈরির মধ্য দিয়ে কয়েকটি বিষয় যে স্পষ্ট হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে: কথিত ক্রসফায়ারের যেসব ভাষ্য পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে সব সময় দেওয়া হয়, তা-ই চূড়ান্ত সত্য নয় এবং তার নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার ৫ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যগুলোতেও বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। ওই সংবাদ সম্মেলনেই রাওয়া ক্লাবের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খন্দকার নুরুল আফসার বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিচারবহির্ভূত ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’ বা ‘হারিয়ে যাওয়ার’ মাধ্যমে ব্যক্তিকে গায়েব করে অপরাধ দমনের প্রবণতার নেতিবাচক দিক প্রকাশ পাচ্ছে। আর লে. কর্নেল (অব.) মাহমুদুর রহমান চৌধুরী প্রশ্ন রেখেছেন, কে বাঁচবে, কে মারা যাবে, তা একজন পুলিশ পরিদর্শক কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন? তাহলে আইন কোথায়, আদালত কোথায়? তাঁদের উচ্চারণে শত শত ভুক্তভোগী পরিবার এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসীদের ন্যায়বিচারের দাবিই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যার যেসব বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে, শুধু সেটুকুই যে তদন্তযোগ্য, ব্যাপারটি তা নয়। গাড়িতে তাঁর সহ-আরোহী এবং হোটেলে থাকা সহকর্মীদের যে ভীতিকর অভিজ্ঞতা ও হয়রানি, তাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো একধরনের প্রবণতা এবং বহুল ব্যবহৃত। একজন সন্দেহভাজন মাদক কারবারি এবং তার সঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকের সংখ্যাই কাহিনি রচয়িতার নির্বুদ্ধিতার পরিচয় প্রকাশ করে দেয়। অপরাধ দমনের এই বেআইনি কৌশল যেহেতু একটি দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা প্রবণতা, সেহেতু এর দায় শুধুই একজন বা কতিপয় ব্যক্তির ঘাড়ে চাপালেই রাষ্ট্রের এ রকম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় শেষ হয় না। যেসব ব্যক্তি এ ধরনের ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহার করে, তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির দায় প্রতিষ্ঠানের। প্রতিষ্ঠানগতভাবে প্রত্যক্ষ উৎসাহ কিংবা পরোক্ষ প্রশ্রয় না পেলে এ ধরনের অপরাধ কখনোই প্রবণতায় রূপান্তরিত হতে পারে না।

প্রত্যক্ষ উৎসাহ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত। মাদকবিরোধী অভিযানে সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে হত্যার কৌশল নীতিগতভাবে অনুমোদিত না হয়ে থাকলে টেকনাফ থানার বিতর্কিত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ মাদক কারবারিদের বাড়ি-গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন কীভাবে? এই ঘোষণাসংবলিত একাধিক ভিডিও নানা মাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরও তিনি স্বপদে বহাল ছিলেন কীভাবে? বস্তুত, এই গুম-খুনের ওপর নির্ভর করে যে কথিত সাফল্য তিনি প্রচার করেছেন, তারই প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে দেওয়া হয়েছে নানা পদক ও উপাধি। তাঁর এই ‘অবিশ্বাস্য গুণ ও সাফল্য’ তুলে ধরে ফরাসি টিভি ফ্রান্স ২৪ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ প্রতিবেদনও প্রচার করে। ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই বলে পুলিশের আইজি যে দাবি আবারও করেছেন, তাতে ইঙ্গিত মেলে যে এই কৌশল বাতিল বা নিষিদ্ধ করতে তাঁরা প্রস্তুত নন। এটি নীতিগত অবস্থান।

৫ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে আইজিপি বলেছেন, ‘ক্রসফায়ার শব্দের সঙ্গে আমরা একমত নই। এটি এনজিওরা বলে।’ ক্রসফায়ার শব্দের সঙ্গে মানবাধিকারকর্মীরাও একমত নন, তাঁরা একে বিচারবহির্ভূত হত্যাই বলে থাকেন। তবে এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, ২০১৫ সালের শুরুতে বেনজীর আহমেদ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালকের পদে দায়িত্ব নিয়ে সমালোচকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না তো কি হাডুডু খেলব?’ তখনো তাঁর বক্তব্যের জবাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা শুনতে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন না (র‌্যাব কেন হাডুডু খেলবে না? প্রথম আলো, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুকূল পরিবেশ তৈরির আরেকটি পদক্ষেপ হচ্ছে, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো তদন্তে স্বাধীন আলাদা তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা। পুলিশ বাহিনীর সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে শীর্ষস্থানীয় পদে থাকা সব সদস্যই জানেন যে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করবেন তাঁদেরই কোনো সহকর্মী। সমব্যথী হিসেবে বিশেষ আনুকূল্য প্রায় সুনিশ্চিত জেনেই তাঁরা বেপরোয়া হতে উৎসাহিত হন। এ ছাড়া পরোক্ষ প্রশ্রয়ের আরেকটি বহুলচর্চিত ব্যবস্থা হচ্ছে গুরুতর অভিযোগ উঠলে সাময়িক প্রত্যাহার, যা আদতে তিরস্কার হিসেবেও গণ্য হয় না।

নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার পরিবার একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে এবং বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি গ্রহণ করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারাধীন মামলার পক্ষে-বিপক্ষের সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো গণমাধ্যমের বিচার্য বিষয় নয়। কিন্তু তদন্তগুলো স্বাধীনভাবে হওয়া প্রয়োজন। মামলা হলেও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের কাউকেই সাময়িকভাবেও বরখাস্ত করা হয়নি। তাঁদের শুধু দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ, সাধারণভাবে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা হলে তার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়ার কথা।

সিনহার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা বিচলিত হয়েছেন। দ্রুততার সঙ্গে সত্য উদ্‌ঘাটনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইনের শাসনে সেটাই প্রত্যাশিত। এ রকম তৎপরতা অতীতে অন্য ঘটনাগুলোর যেকোনো একটির ক্ষেত্রেও যদি দেখা যেত, তাহলে সম্ভবত এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুটি এড়ানো যেত। (জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির শুনানিতে উত্থাপিত হিসাব বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সময়কালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ২,০৮৮ জন।) ভবিষ্যতে যাতে এ রকম মৃত্যু আর কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেই না ঘটে, তা তিনি সামরিক কিংবা বেসামরিক যে পরিবারের সদস্যই হোন না কেন, তা নিশ্চিত করার একটাই উপায়, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম নিষিদ্ধ করা। আর সেই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে প্রয়োজন জবাবদিহি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ন্যায়সংগত পথও একটিই—স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত ব্যবস্থা এবং সুষ্ঠু-স্বচ্ছ বিচার। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি মেজর সিনহার বিচারের মধ্য দিয়ে এই বেআইনি নীতির অবসান দেখতে পাব?