ভূমিপূজা ঢেকে দিল কাশ্মীরের হাহুতাশ

অযোধ্যায় ভূমিপূজার মধ্যমণি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
অযোধ্যায় ভূমিপূজার মধ্যমণি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

বুধবার ছিল ২০ শ্রাবণ, ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৫ আগস্ট। হিন্দু পঞ্জিকামতে কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়া। দিনটা যে মঙ্গলময় বা শুভলক্ষণজনক, পঞ্জিকায় তেমন কোনো উল্লেখ নেই। তবে মহীয়সী খনা বলে গেছেন, ‘মঙ্গলে উষা বুধে পা, যথা ইচ্ছে তথা যা’। অর্থাৎ, মঙ্গলের রাত পেরিয়ে বুধের সূর্যোদয়ের সন্ধিক্ষণে কাজ শুরু করলে সাফল্য অবধারিত। সেই দিক থেকে দেখলে দিন হিসেবে বুধবার নিশ্চয়ই শুভই ছিল। যদিও খচখচানিটা যাচ্ছিল না। কেননা, সময়টা উষাকাল ছিল না। দ্বিপ্রহর।

পঞ্জিকাতেও আহামরি তেমন কোনো দিন-মাহাত্ম্যের উল্লেখ ছিল না। শুভ কর্ম হিসেবে ওই দিন যা যা করা যায়, সেই তালিকায় ক্রয়-বাণিজ্য, শান্তি–স্বস্ত্যয়ন, ধান্য স্থাপন, বীজ বপন, কারখানা স্থাপনের সঙ্গে লেখা দেবতা গঠন। পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, দেবতা গঠন বলতে বোঝায় দেবতার মূর্তি তৈরির কাজে হাত দেওয়া। অথচ অযোধ্যায় বুধবারের দ্বিপ্রহরে যা হলো, তার সঙ্গে দেবতা গঠনের সম্পর্ক ছিল না। উপলক্ষ ছিল নতুন রামমন্দিরের ‘ভূমিপূজা’। 

ঠিক দুদিন আগে, ৩ আগস্ট দিনটা কিন্তু তুলনায় বেশি শুভ ছিল। পঞ্জিকা অনুযায়ী, সেদিন ছিল পূর্ণিমা। শুভকর্মের মধ্যে ছিল দীক্ষা দান, গাত্র হরিত্রা, গৃহ প্রবেশ ও গৃহারম্ভ। ভূমিপূজা তো মন্দির নির্মাণের প্রাক্‌–কর্তব্য! ভূমিপূজাই তো গৃহারম্ভের প্রথম ধাপ! তাহলে ৩ আগস্টের শুক্লপক্ষ ও পূর্ণিমার ঝলমলে পুণ্যক্ষণ উপেক্ষা করে মন্দির তৈরির শুভারম্ভের জন্য ৫ আগস্টকে কেন বেছে নেওয়া হলো? 

উত্তরটা অজানা। কিন্তু এটা জানা, ঠিক এক বছর আগে ওই দিনে এই সরকার এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যা নিয়ে অসন্তোষ, বিতর্ক ও মামলা অব্যাহত। বিতর্ক দেশজুড়ে, অসন্তোষ রাজ্যে, যদিও শাসকদলীয় সমর্থকেরা আশাবাদী। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত হয়। রাজ্য ভেঙে গঠিত হয় দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ। প্রত্যাহৃত হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ, যা জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল।

ঠিক আগের দিন থেকে রাজ্যজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। জম্মু-কাশ্মীর ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটসের জুলাই ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী, মোট ৬ হাজার ৬০৫ জন রাজনৈতিক কর্মী (১৪৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক) আটক, ৪৪৪ জন বর্ষপ্রাচীন জননিরাপত্তা আইনে। যথেচ্ছ প্রয়োগ হয় ‘ইউএপিএ’ আইনেরও। ঢালাও নির্দেশ ‘কর্ডন অ্যান্ড সার্চ অপারেশনের’। শুধু উপত্যকাতেই মোতায়েন হয় অতিরিক্ত ৩৮ হাজার বাহিনী। প্রতিষ্ঠিত নেতা-নেত্রীদের সরকারি নিরাপত্তা ও সুবিধা প্রত্যাহৃত হয়। নিষিদ্ধ হয় রাজনীতির অধিকার। নেতাদের মুক্তির প্রাথমিক শর্ত রাজনীতি না করার মুচলেকা। নাগরিক জীবন অধিকারহীন। নতুন মিডিয়া নীতির বেড়ি পরে গণমাধ্যমে। বর্ষপূর্তির আগে চালু হয় ২–জি ইন্টারনেট পরিষেবা। ৩–জি যদিও মরীচিকা। উপত্যকার খবর সেটুকুই বাইরে আসছে প্রশাসন যতটুকু জানাতে চায়। গোটা কাশ্মীর যেন এক সুবিশাল জেলখানা! 

বছর ঘুরে গেল। গণতান্ত্রিক পরিসরের উথালপাতাল আলোড়ন কিন্তু এখনো নিস্তরঙ্গ দিঘির রূপ নিল না। অসন্তোষের ফুলকি সদা দৃশ্যমান। জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনের সাংবিধানিক বৈধতার বিবেচনা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় কবে করবে, কেউ জানে না! এই অমোঘ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট বিদ্ধ। এতগুলো মামলা অমীমাংসিত। স্থগিতাদেশের আরজিও খারিজ। ফলে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে যা যা করণীয়, সব চলছে বিনা বাধায়। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের এহেন নিরুচ্চার দীর্ঘসূত্রতার সমতুল্য কোনো উদাহরণ এই দেশে আছে কি? বর্ষপূর্তির দিনে এই সব প্রশ্নে নতুন করে উচ্চকিত কলরব যাতে না ওঠে, উঠলেও যাতে ঢেকে দেওয়া যায়, সে জন্যই কি ৫ আগস্ট দিনটা বেছে নেওয়া? 

কাশ্মীর সিদ্ধান্তের ‘সাফল্যের’ সরকারি সাতকাহন ও আশাবাদের উল্লেখ অবশ্যই করা প্রয়োজন। সরকারি বয়ান অনুযায়ী, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ছত্রখান। তাই গত এক বছরে একটিও বনধের ডাক কেউ দেয়নি। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ৮২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং তাতে মজুত ৭০ লাখ ৫০ হাজার রুপি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জামাত-ই-ইসলামির ১৯টি ডেরায় তল্লাশি হয়েছে। পাথর ছোড়া বিক্ষোভ কমে গেছে। ২০১৮ সালে উপত্যকায় ‘পাত্থরবাজির’ ঘটনা ঘটেছিল ৫৩২টি, ২০১৯-এ ৩৮৯, ২০২০ সালে ১০২। এই অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিল যথাক্রমে ২ হাজার ২৬৮, ১ হাজার ১২৭ ও ১ হাজার ১৫২ জন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে সাড়ে ৪০০ সন্ত্রাসীকেও। গত মার্চ মাসে সংসদ বন্ধ হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংসদে জানান, ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ হওয়ার পর থেকে উপত্যকায় মোট ৭৯টি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, যাতে নিহত ৪৯ জন সন্ত্রাসী। পুলওয়ামা বিস্ফোরণে মারা যান ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান। তারপর বিভিন্ন হানায় মারা যান আরও ৪২ জন নিরাপত্তারক্ষী। এক বছরে এত ‘সাফল্য’, তবু ৪ ও ৫ আগস্ট গোটা উপত্যকায় জারি হয় কারফিউ! কারণ, সাবধানের মার নেই।

সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের অঙ্গীকার প্রাচীন। প্রতিশ্রুতি পালন করতে পেরে বিজেপি উৎফুল্ল। গত বছরের ৫ আগস্টের সরকারি বয়ান ছিল, ঐতিহাসিক ভুল সংশোধনের মাধ্যমে বৈষম্য দূর হলো। আশা, এতদ্দ্বারা সারা দেশের মতো ওই দুই অঞ্চলেরও সার্বিক উন্নয়ন ঘটবে। সন্ত্রাসবাদ পরাস্ত হবে। হিংসা দূর হবে। শিল্প স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ উৎসাহিত হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে। স্থানীয় মানুষ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন। গৃহত্যাগী হিন্দুরা উপত্যকায় ফিরবেন। মাত্র তিনটি পরিবারের মুঠো থেকে মুক্ত হবে রাজ্য। জন্ম নেবে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। 

এক বছরে সেই লক্ষ্য কতটা পূর্ণ? কাশ্মীর চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাবে এই এক বছরে শুধু উপত্যকাতেই উৎপাদন ক্ষতি ৪০ হাজার কোটি টাকার। ফল, পোশাক, কার্পেট, হোটেল, পর্যটন, পরিবহন, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও অন্যান্য শিল্পে কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। ২০১৭ সালে উপত্যকায় পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১১ হাজার ৫৩৪। ২০১৮ সালে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪২৪ জন। ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৯ জন। সন্ত্রাসী হানা বন্ধ হয়নি। স্বাভাবিকতাও ফেরেনি। কিছু দলছুট সরকারি উদ্যোগে নতুন দল গড়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন এখনো করা যায়নি। রাজ্যে শেষ পঞ্চায়েত ভোট ২০১১ সালে। এযাবৎ আটজন পঞ্চায়েতপ্রধান খুন হয়েছেন। ইস্তফা দিয়েছেন সাড়ে ৩০০ জনের বেশি পঞ্চায়েত সদস্য। কেন্দ্রীয় কাশ্মীরে ৭৭ দশমিক ৮৭, দক্ষিণ কাশ্মীরে ৮৩ দশমিক ৪৭ এবং উত্তর কাশ্মীরে ৪৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ পঞ্চায়েত আসন শূন্য। আস্থা ও ভরসার অভাবে বেসরকারি শিল্প উদ্যোগ এখনো অথই জলে। তারই অভাবে গৃহত্যাগী হিন্দুরাও প্রত্যাবর্তনে অনাগ্রহী। প্রবীণদের নতুন বাধা নব প্রজন্ম।

অযোধ্যায় ভূমিপূজার মধ্যমণি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। হিন্দুত্ববাদের চুইয়ে পড়া ভক্তিরস ও জাঁকজমকের চোখধাঁধানো লাইভ টেলিকাস্ট, রঙের রোশনাই, কাড়া-নাকাড়া-দুন্দুভির অবিরাম ‘ক্যাকোফনি’এবং গণমাধ্যমগুলোয় অঙ্গীকার পূরণে সরকারের সাহসী ভূমিকার দিনভর চর্চায় কাশ্মীরি নব অধ্যায়ের বর্ষপূর্তির বিলাপ ও হাহুতাশ চাপা পড়ে গেল। কে জানে, ৫ আগস্টের মাহাত্ম্য হয়তো এটাই!  


সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি