এক গুণী চিকিৎসকের বিদায়

এ কে এম নুরুল আনোয়ার।
এ কে এম নুরুল আনোয়ার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এ কে এম নুরুল আনোয়ার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে গত ৫ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, সচেতন শিক্ষাবিদ ও গবেষক বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েছেন। চলমান চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষ পেশাজীবী চিকিৎসক তৈরি করার লক্ষ্যে তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল অসাধারণ। নীতিবান পেশাজীবী চিকিৎসক গঠনের লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

এ কে এম নুরুল আনোয়ারের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তিনি ১৯৬৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তখনকার আইপিজিএম অ্যান্ড আর (এখনকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ফার্মাকোলজিতে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭৪ সালে। ১৯৮২ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি (ফার্মাকোলজি) ডিগ্রি লাভ করেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) ১৯৯৭ সালে তাঁকে অনারারি এফসিপিএস ফেলো হিসাবে সম্মানিত করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে ফার্মাকোলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে সম্মানিত করে।

তিনি ১৯৬৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগের ডেমোনস্ট্রেটর হিসেবে; ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থার পুরোনো কাঠামো বদলে উন্নত দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার আধুনিক কারিকুলাম প্রয়োগের বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৬ সালে সরকার তাঁকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেয়। তিনি ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান নীতিনিষ্ঠ প্রশাসক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের সময়ে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যসেবায়, বিশেষ করে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি ও যক্ষ্মার চিকিৎসায় ডাইরেক্টলি অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট শর্ট কোর্স (ডটস) প্রবর্তনে অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। এই সময়ে এ দেশের মাতৃমৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে তিনি একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কলেজটিকে মানসম্পন্ন চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নৈতিকতার মানেও অনন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায়।

নুরুল আনোয়ার বাংলাদেশে প্রয়োজন–অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক ওষুধ সেবনের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। চিকিৎসকেরা যাতে রোগীদের পরামর্শপত্র লেখার সময় ওষুধের যথাযথ ও যৌক্তিক ব্যবহারের (র‍্যাশনাল ইউজ অব ড্রাগ) দিকে দৃষ্টি রাখেন, সে বিষয়ে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের ন্যাশনাল ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন ও হসপিটাল ফরমুলারি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসনের প্রথম ওষুধ ফর্মুলারি প্রকাশনার (বিডিএনএফ) প্রধান সম্পাদক (২০০১-২০০২) ছিলেন।

এ ছাড়া তিনি ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক আইসিডিডিআরবির এথিক্যাল রিভিউ কমিটির (ইআরসি) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষকদের চিকিৎসা গবেষণায় নৈতিকতার গুরুত্ব তিনি সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এখন চিকিৎসাশাস্ত্রে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের এথিক্যাল রিভিউ কমিটির কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়েই কাজ শুরু করতে হয়।

নুরুল আনোয়ার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। অমায়িক সজ্জন হিসেবে পরিচিত এ মানুষটি যখন যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, সেখানে সহকর্মীদের নিয়ে টিম গঠন করতেন। যৌথতা ও পরস্পর সহযোগিতা ছিল তাঁর কর্মপদ্ধতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক। টিমওয়ার্কের ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষ কাজ আর অতিরিক্ত বোঝা বলে মনে হতো না। তিনি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সেই সময় প্রভাষক হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য লাভ আমার জীবনের এক মূল্যবান অভিজ্ঞতা। তিনি সবারই প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁকে বেহেশতবাসী করুন।

*আফসানা করিম: চিকিৎসক, বারডেম হাসপাতাল