সামনে কি আরেকটি 'পবিত্র ধর্মযুদ্ধ'

যুক্তরাষ্ট্রের বহু ইভানজেলিক্যাল শ্বেতাঙ্গ নাগরিক বিশ্বাস করেন, বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য স্বয়ং ঈশ্বর আমেরিকাকে মহান দায়িত্ব দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, ঠিক এ কারণে যখনই যেখানে সামরিক অভিযান চালানো উচিত বলে মনে হবে, তখনই সেখানে আমেরিকার অভিযান চালাতে হবে। এটিকে তাঁরা ক্রুসেড বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বলে মনে করেন।

এই ক্রুসেডিয়ান মানসিকতাই যুক্তরাষ্ট্রকে বারবার কূটনৈতিক পন্থা থেকে সরিয়ে যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আবার সেই ভয়ংকর খেলায় নামতে পারে—এমন একটা আভাস সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে।

গত মাসেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আরেকটি ইভানজেলিক্যাল ক্রুসেডের ঘোষণা দিয়েছেন। এবারের লক্ষ্যবস্তু চীন। তাঁর বক্তব্য এতটাই উগ্র ও ভয়ানক ছিল যে তা যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের সঙ্গে সংঘাত বাধিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

পম্পেও বলেছেন, বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের জন্য চীন যুগ যুগ ধরে যে অভিলাষ লালন করে আসছে, তা বাস্তবায়নের জন্য সি চিন পিং মরিয়া হয়ে উঠেছেন; চীন যুদ্ধবাজের মতো সবার ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে।

পম্পেওর এই বক্তব্য স্পষ্টতই একটি কূটাভাস। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ, যার প্রতিরক্ষা কৌশলনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিশ্বের অদ্বিতীয় ও অলঙ্ঘে্যয় সামরিক শক্তি’ বলে উল্লেখ করা আছে। মার্কিন কৌশল নীতিতে এই ‘অদ্বিতীয় সামরিক শক্তি’ ইন্দো–প্যাসিফিক, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ সবখানে বাধাহীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম চালাবে—এমনটা বলা আছে। অন্যদিকে চীনের প্রতিরক্ষাবিষয়ক শ্বেতপত্রে বলা আছে, ‘চীন কখনোই বড় বড় শক্তির আধিপত্যবাদী পথ অনুসরণ করবে না।’

বাইবেলে যিশুর বাণী এসেছে, ‘ভণ্ড! প্রথমে তোমার নিজের চোখ থেকে তক্তাটা বের করে ফেলো, তাহলে তোমার ভাইয়ের চোখ থেকে কুটোটা বের করার জন্য স্পষ্ট দেখতে পাবে (মথি ৭: ৫)।’

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সামরিক ব্যয় ছিল ৭৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার; আর চীনের এই খাতে ব্যয় ছিল ২৭ হাজার ১০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ চীনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ছিল প্রায় তিন গুণ। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের আছে প্রায় ৮০০ সামরিক ঘাঁটি। অন্যদিকে চীনের আছে মাত্র ১টি (জিবুতিতে একটি ছোট নৌঘাঁটি)। চীনের আশপাশে যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঘাঁটি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ৫ হাজার ৮০০ পরমাণু ওয়ারহেড আছে। চীনের হাতে আছে মাত্র ৩২০টি। যুক্তরাষ্ট্রের আছে ১১টি বিমানবাহী রণতরি। চীনের আছে মাত্র ১টি। গত ৪০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বহু দেশে একতরফাভাবে যুদ্ধ চালিয়েছে। বহু দেশের ওপর হামলা চালিয়েছে। চীন এখনো সে ধরনের একটি অভিযানও চালায়নি। উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর চীন নির্যাতন চালাচ্ছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও চীনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্প নিজে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে উইঘুর মুসলমানদের দমন করার জন্য উৎসাহিত করেছেন বলে তাঁর সাবেক উপদেষ্টা জন বোল্টন দাবি করেছেন।

চীন বিশ্বে খবরদারি করার অভিলাষের কথা অস্বীকার করলেও বিশ্বের সবখানেই এই গুঞ্জন আছে যে চীন যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা দখল করতে চাচ্ছে। ২০৪৯ সালের মধ্যে তারা ‘সম্পূর্ণ উন্নত’ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। আগামী মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা জিতলে সেই সরকার চীনের সমালোচনা করবে না, তা নয়। তবে তারা কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চীনবিরোধী বক্তব্য দেবে। কিন্তু যদি ট্রাম্প আবার জয়ী হন, তাহলে এই পম্পেও এমন কোনো ভাষণ দিয়ে বসতে পারেন, যা ভয়াবহ যুদ্ধোন্মাদনার সৃষ্টি করতে পারে।

সম্প্রতি প্রকাশিত আমার বই আ নিউ ফরেন পলিসিতে আমি দেখিয়েছি, আমেরিকায় ইংরেজ প্রোটেস্ট্যান্টরা বসতি গড়ে তোলার পর তাঁদের অনেকের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভূমি ইসরায়েলের মতো আমেরিকাও তাঁদের প্রতিশ্রুত ভূমি। স্বয়ং ঈশ্বর তাঁদের জন্য এই দেশ বরাদ্দ করেছেন। তাদের উত্তরসূরিরা এখন মনে করছেন, ঈশ্বর আমেরিকার মাধ্যমে সারা দুনিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করবেন। নাইন–ইলেভেন হামলার পর এই ইভানজেলিক্যাল চেতনা থেকেই মার্কিন সরকার আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় হামলা চালায়।

পম্পেও ২০১৫ সালে কানসাসে কংগ্রেসম্যানদের এক মিটিংয়ে বলেছিলেন, আমেরিকা হচ্ছে ইহুদি–খ্রিষ্টান জাতির দেশ। তাঁদের কর্তব্য হলো যিশুর পুনরাগমন পর্যন্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। পম্পেওর এই মানসিকতা অতি গভীরে প্রোথিত। যদি কোনোভাবে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প জিতে যান, তাহলে এই পম্পেওর কারণে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বেধে যেতেও পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি. স্যাক্স: কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক