একটি মানবিক ও সংবেদনশীল সমাজের স্বপ্ন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ বলেছে, বিশ্বব্যাপী ইনডিজিনাস পিপলস বা আদিবাসী জনগণ ঐতিহাসিকভাবে নানামুখী শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতিকে জাতিসংঘ এই কারণে গুরুত্ব দেয় যে এদের জীবনধারা প্রকৃতি, বন, জলধারা, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধরিত্রী ও জলবায়ুর জন্য সহায়ক। এই আদি অধিবাসীদের সংখ্যা বিশ্বে শতকরা ৫ ভাগ, কিন্তু বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ৮০ ভাগ তারা সংরক্ষণ করে। কে এতকাল আমাদের জন্য বন, পাহাড়-পর্বত, নদী, প্রকৃতি রক্ষা করেছে? এই আদিবাসীরা।

আমি একবার জাতিসংঘ সদর দপ্তর নিউইয়র্কে এক অধিবেশনে শুনেছিলাম, বক্তারা বলছিলেন, ওরা আছে বলেই এই ধরিত্রী এত সুন্দর, বর্ণ–বৈচিত্র্যময়। অন্যদিকে এই জনগণ তাদের মাতৃভাষাসহ সব হারাতে বসেছে বর্তমান উন্নয়নধারায়। এই কারণে জাতিসংঘ তাদের জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১৯৮২ সালে ওয়ার্কিং গ্রুপ, ১৯৯৩ সালকে ইন্টারন্যাশনাল ইয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ইনডিজিনাস পিপলস, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪ সালে রেজল্যুশন গ্রহণ করে আদিবাসী দিবস ঘোষণা, ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সালকে প্রথম আদিবাসী দশক ঘোষণা, ২০০০ সালে স্থায়ী ফোরাম গঠন, ২০০১ সাল থেকে বিশেষ দূত নিয়োগ, ২০০৫-২০১৪ সালকে দ্বিতীয় দশক ঘোষণা, ২০০৭ সালে অধিকার ঘোষণাপত্র গ্রহণ, একই বছর জেনেভাভিত্তিক হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের অধীনে এক্সপার্ট মেকানিজম প্রতিষ্ঠা, ২০১৪ সালে সাধারণ পরিষদে নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অন ইনডিজিনাস পিপলস আয়োজন এবং ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’ গ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়’ স্লোগান নিয়ে যে এসডিজি অ্যাজেন্ডা জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, সেখানে আদিবাসীদের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। এই করোনাকালেও ভবিষ্যতে এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সংগঠন কীভাবে অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারে, তার উপায় খুঁজে বের করা জরুরি। এই দিবস উদ্‌যাপনের মূল লক্ষ্য হলো আদিবাসীদের জীবনধারা ও মানবাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা।

২.

মহাশ্বেতা দেবী তাঁর গঙ্গা-যমুনা-ডুলং-চাকা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘গঙ্গা-যমুনার সঙ্গে ডুলং, নেংসাই, চাকা এসব নদীকে মেলানোর কাজ তো শুরুই হয়নি। কবে হবে তা জানি না। শুধু এটা জানি যে পরিণামে মূল স্রোতকে, সমগ্র দেশকে ভীষণ দাম দিতে হবে এই উপেক্ষার। আর কাদের উপেক্ষার? যারা সত্যিই তো অনেক অনেক সভ্য আমাদের চেয়ে। মেয়ের বাপ পণ দেয় না, সতীদাহ বা পণের কারণে বধূ হত্যা জানে না, কন্যাসন্তানকে হত্যা করে না, বিধবাবিবাহ স্বীকৃত, উপযুক্ত কারণ থাকলে বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহ স্বীকৃত, এমন উন্নত সামাজিক প্রথা যাদের, তাদের উপেক্ষা করলাম। তারা যে সভ্য, উন্নত, শ্রদ্ধেয় মূল স্রোত সেটা জানার চেষ্টাই করল না। এর দাম আমাদের দিয়ে যেতে হচ্ছে, হবে। কোনো দিন ভারতের সত্যি ইতিহাস লেখা হবে। সে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না, যদি আমরা এখনো না বুঝি।’

মহাশ্বেতা দেবী কথাগুলো ভারতের আদিবাসীদের বিষয়ে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উদ্দেশে বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য কথাগুলো কি প্রযোজ্য নয়? আমরা আশা করব, আগামী দিনে আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও অস্তিত্বকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃতি শুধু নয়, বৈচিত্র্যকে গর্বের সঙ্গে উদ্‌যাপন করা হবে।

জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের ৯০টি দেশে ৪০ কোটির বেশি আদিবাসী রয়েছে। জাতিসংঘ ২০২০ সালের আদিবাসী দিবসের মূল সুর হলো, ‘কোভিড–১৯ অ্যান্ড ইনডেজিনিয়াস পিপলস রেজিলিয়েন্স’ বর্তমান বাস্তবতায় এই মূল সুর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই মানুষেরা দরিদ্রদের মধ্যেও প্রান্তিক। তারা ঐতিহাসিকভাবে উপেক্ষা, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। এখন করোনার কারণে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়।

আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এরই মধ্যে আমাদের দেশে সমতলের আদিবাসীরা শতকরা ৭০ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। পোশাককর্মী, হোটেলকর্মী, বিউটি পারলারের নারী কর্মী, গাড়িচালক, গৃহকর্মী, সিকিউরিটি গার্ড ও অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের অনেকে চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। এই ধরনের চাকরি হারানো মানুষের সংখ্যা অন্তত কয়েক হাজার হবে। কৃষি ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত আদিবাসীদের অবস্থাও অনিশ্চিত। যাঁরা দিনমজুর ও দৈনিক পারিশ্রমিকের কাজ করেন, তাঁদের জীবনেও নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। আমরা কেউ জানি না কোভিড পরিস্থিতি কবে শেষ হবে। এই পরিস্থিতি যদি আরও দীর্ঘায়িত হয়, তবে এই প্রান্তিক মানুষের অবস্থা হবে আরও শোচনীয়। তারা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, আদিবাসীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়া হোক।

একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সবার জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম। নিশ্চয় আমরা সেই অঙ্গীকার থেকে সরে যাইনি। আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার অংশের তৃতীয় ভাগে ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আবার ২৮(৪) অনুচ্ছেদে আছে, ‘...নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ তাই আমরা আশা করব, একদিন অধিকারবঞ্চিত সব নাগরিকের জন্য আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি অনেক বেশি ইনক্লুসিভ, মানবিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকর রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক সংখ্যালঘু জাতির মানুষ তার রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বিশেষ মর্যাদার আসন পাবে, রাষ্ট্র হবে অনেক বেশি সংবেদনশীল।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশ তার বিশালত্ব ও মহত্ত্বের প্রমাণ দেবে আদিবাসীসহ সব প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করে। কেননা, একটি দেশ ও সমাজ কতটা উন্নত ও সভ্য, তার বিচার্য বিষয় হলো সেই দেশ ও সমাজ প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এত বড় অর্জন যে জাতির, যে স্বাধীনতার, তার ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা সবাই একসঙ্গে আনন্দ উদ্‌যাপন করব, উৎসব করব, এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
[email protected]